দুই
টেনশনের চোটে পিটারের অবস্থা কাহিল। বাবা ওকে নীচে নামতে বলেছেন। সামনে ভীষণ বিপদ, ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলে দিচ্ছে পিটারকে। কিন্তু বাবাকে যেতে নিষেধ করার সাহস তার নেই। যাব না কথাটি উচ্চারণ করতে পারেনি সে। কারণ তার ভয় এতে প্রচণ্ড রেগে গিয়ে সার রোনাল্ড কোনও অঘটন ঘটিয়ে ফেলতে পারেন। বিশ্রি, পেট গুলিয়ে ওঠা গর্তটার মধ্যে প্রবল অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাবার সঙ্গে নেমে পড়ে পিটার।
পাণ্ডুলিপিতে বর্ণিত দরজাই ছিল ওটা। দরজার গায়ে, ঠিক মাঝখানে মিসরীয়দের সাত প্রধান দেবতার মাথার ছবি – অসিরিস, ইসিস, রা, বাস্ত, থথ, সেট এবং অ্যানুবিস। তবে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার সাতটা মাথার অধিকারী সাতজন নয়, একজন। আর ওটা কোনও মানুষের শরীরও ছিল না, ভয়াবহ এই আকৃতির সঙ্গে তুলনা করার মত উপমা বোধহয় মিসরীয় কোনও বইতেও নেই। অন্তত ওই মুহূর্তে পিটারের কিছু মনে পড়েনি।
সাত মাথার ভয়াল ভয়ঙ্কর জিনিসটা দেখামাত্র ভয়ে প্রায় জমে যাচ্ছিল পিটার, আতঙ্কের অক্টোপাস যেন চারপাশ থেকে ওকে তড়িৎ গতিতে চেপে ধরেছিল। সাত মাথার নীচের অংশটার যেন দ্রুত রূপান্তর ঘটছিল; মনে হচ্ছিল গলে যাচ্ছে। অবিশ্বাস্য এবং অদ্ভুত সব আকার ধারণ করছিল ওটা। কখনও ওটাকে মনে হয়েছে সর্পিণী মায়াবিনী মেডুসা, কখনও বিশাল, বিকট ভ্যাম্পায়ার ফুলের চেহারা ধারণ করেছে, ছড়িয়ে দিয়েছে বিরাট পাতা, যেন রক্ত-তৃষ্ণায় বাতাসে দুলছিল। তারপরই চোখের পলকে ওটা পরিণত হয়েছে একদলা চকচকে রুপালি খুলিতে। আবার পরক্ষণে রুপালি খুলির রূপান্তর ঘটেছে নিখিল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে, অজস্র তারকা আর গ্রহসহ।
এ যেন এক দুঃস্বপ্ন। কোনও শিল্পীর পক্ষে এমন বীভৎস ছবি আঁকা সম্ভব নয়। একমাত্র শয়তানের পক্ষেই এ কাজ সম্ভব। সাত মাথার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে প্রায় সম্মোহিত হয়ে পড়েছিল পিটার। বাস্তবে ফিরে আসে বাবার ডাক শুনে। সার রোনাল্ড সকালবেলাতেও কাঠখোট্টা ব্যবহার করলেও এখন তাঁর চেহারা আমূল বদলে গেছে। রীতিমত উৎসুক গলায় তিনি ঘোষণা করেন। ‘এটাই সেই দরজা। এই দরজার কথাই পার্চমেন্টে লেখা আছে। এখন বুঝতে পারছি প্রিন তাঁর শয়তানের পূজা অধ্যায়ে কীসের কথা বলতে চেয়েছেন। ওই অংশে তিনি দরজায় প্রতীকের কথা উল্লেখ করেছেন। যাকগে, কাজ শেষ হবার পর আমরা এটার কয়েকটা ছবি তুলব। আশা করি ছবি নিয়ে নিরাপদেই ফিরতে পারব। স্থানীয়রা কোনও ঝামেলা করবে না।’
সার রোনাল্ডের কণ্ঠে খুব বেশি উৎসাহের সুর। ব্যাপারটা ভাল লাগল না পিটারের, বরং ভয় হলো। হঠাৎ মনে হলো সে তার বাবাকে খুব কম চেনে। বাপের সাম্প্রতিক গোপন কর্মকাণ্ড সম্পর্কেও সে কত কম জানে।
গতরাতেও সে তার বাবাকে দেখেছে একটা সমাধি থেকে বেরিয়ে আসতে, হাতে মরা বাদুড়। বাবাকে পাগল সন্ন্যাসীদের মত মনে হচ্ছিল। বাবা কি সত্যি এসব ছাইপাঁশ বিশ্বাস করেন!
‘এখন!’ বিজয় উল্লাস বৃদ্ধের কণ্ঠে। ‘ছুরিটা নিয়েছি। পিছনে যাও।’
ভীত, বিস্মিত চোখে পিটার দেখল বাবা ছুরির ডগাটা সপ্তম মাথা অর্থাৎ অ্যানুবিসের নীচে গাঁথলেন। খরখর শব্দ হলো, তারপর কুকুরমুখো মাথাটা ধীরে ঘুরে যেতে লাগল, যেন গোপন কোনও হাতলের সাহায্যে। ঝনঝন শব্দে খুলে গেল দরজা, প্রতিধ্বনিটা অনেকক্ষণ রইল।
একটা তীব্র, ঝাঁঝাল গন্ধ নাকে বাড়ি খেল। গন্ধটা নাক সয়ে এলে সার রোনাল্ড দ্রুত পা রাখলেন ভেতরে। সঙ্গে পিটার। পাণ্ডুলিপির নির্দেশ অনুযায়ী গুনে গুনে তেত্রিশ পা এগোলেন। তারপর মুখোমুখি হলেন অ্যানুবিসের।
মশালের আলোয়, পিটারের মনে হলো…মূর্তিটার গায়ের রং পাল্টে যাচ্ছে। ঠোঁটের হাসিটা হঠাৎই যেন অদৃশ্য হয়ে গেল, কঠিন হয়ে উঠল চেহারা, দুই ঠোঁটে ফুটল প্রবল নিষ্ঠুর ভাব। হাঁ করে অ্যানুবিসের এই পরিবর্তন দেখছে পিটার, চমক ভাঙল সার রোনাল্ডের ডাকে।
‘শোন, খোকা, সেদিন রাতে পার্চমেন্টের সমস্ত কথা তোকে বলিনি। তোর নিশ্চয়ই মনে আছে একটা অংশ আমি মনে মনে পড়েছিলাম। হ্যাঁ, ওই অংশটা। তোকে জানতে না দেয়ার পেছনে অবশ্যই কারণ ছিল। কারণ পুরোটা জানলে তুই হয়তো ভুল বুঝে এখানে আসতে চাইতি না। তাই সব কথা বলার ঝুঁকিটা ও সময় নিতে চাইনি।
‘তুই জানিস না, পিটার, এই মুহূর্তটি আমার কাছে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ। বহু বছর আমি এমন সব গোপন বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করেছি যা অন্যের কাছে স্রেফ আজগুবি কুসংস্কারাচ্ছন্ন ব্যাপার ছাড়া অন্য কিছু নয়। কিন্তু আমি এসব বিশ্বাস করতাম। প্রতিটি বিস্মৃত কর্মের পেছনে একটি নগ্ন সত্য থাকে; বিকৃত ঘটনাও বৈধতা পেয়ে বাস্তবতায় নতুন ধারণা সৃষ্টি করতে পারে। আর এ ধরনের কোনও ঘটনার সন্ধানে আমি বহুদিন নিরলস কাজ করেছি-বিশ্বাস করতাম এরকম কোনও সমাধি যদি আবিষ্কার করতে পারি তা হলে গোটা বিশ্বকে প্রমাণ এবং যুক্তি দিয়ে বোঝাতে সমর্থ হব। এই মূর্তির মধ্যে সম্ভবত গোপন প্রেতপূজারীদের মমি রয়েছে। তবে তার জন্য আমি আসিনি। আমি এসেছি তাদের জ্ঞানের সন্ধানে। যে জ্ঞান তাদের সঙ্গে একই সময় কবর দেয়া হয়। এসেছি সেই প্যাপিরাসের পাণ্ডুলিপির খোঁজে যাতে আছে নিষিদ্ধ গোপন সব তথ্য-জ্ঞান, যার কথা পৃথিবীর মানুষ কখনও জানার সুযোগ পায়নি। জ্ঞান-এবং ক্ষমতা!