‘দেবতার প্রথমদিকের চেহারা বাকিগুলো থেকে ভিন্ন’ বর্ণনা করেছে পাণ্ডুলিপি। ‘তবে এই চেহারা দেখা সাধারণ মানুষের জন্যে মঙ্গলজনক নয়, তাই পূজারী প্রভুরা যুগ যুগ ধরে তাঁর প্রকৃত চেহারা লুকিয়ে রেখেছেন এবং তাঁর প্রয়োজন অনুসারে তাঁর পূজা করেছেন। কিন্তু এখন আমাদের শত্রুরা-ওদের আত্মা পুড়ে মরুক, পচন ধরুক শরীরে।-ধর্মীয় আচার- অনুষ্ঠানকে অবজ্ঞা করার সাহস দেখালে প্রভু তাঁর প্রতিবিম্ব লুকিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নেন এবং তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে তাঁর প্রতিবিম্বকেও কবর দেয়া হয়। ‘
শেষের লাইনগুলো সার রোনাল্ড আরও দ্রুত পড়ে গেছেন, বার বার কেঁপে উঠেছে তাঁর কণ্ঠ: ‘কিন্তু গুহার শেষ মাথায় অ্যানুবিস শুধু এই কারণে একা দাঁড়িয়ে নেই। তিনি আক্ষরিক অর্থেই পথপ্রদর্শক, এবং তাঁর সাহায্য ছাড়া কেউ সমাধির ভেতরে প্রবেশ করতে পারবে না।’
এই পর্যন্ত পড়ে অনেকক্ষণ চুপচাপ থেকেছেন বুড়োমানুষটি।
‘কী হলো?’ অধৈর্য পিটার জানতে চেয়েছে। ‘আমার ধারণা এই শেয়াল দেবতাকে নিয়েও অনেক আজগুবি পূজা-অর্চনার কথা আছে, তাই না?’
সার রোনাল্ড জবাব দেননি, নীরবে কী যেন ভাবছিলেন। পিটার লক্ষ করেছে পার্চমেন্ট ধরা বাবার হাত দুটো কাঁপছে। যখন চোখ তুলে চেয়েছেন, ভয়ানক বিমর্ষ লাগছিল তাঁকে। ‘হ্যাঁ, খোকা’-ঘড়ঘড়ে গলায় জবাব দিয়েছেন তিনি। ‘ঠিক তাই-আরেক অনুষ্ঠানের কথা বলা আছে ওখানে। কিন্তু ওখানে যাওয়ার আগে এ নিয়ে মাথা না ঘামালেও চলবে।’
‘তার মানে তুমি ওখানে যাবে জায়গাটা খুঁজে দেখবে?’ উৎসুক হয়ে শুধিয়েছে ছেলে। ‘অবশ্যই যাব,’ যেন জোর করে কথাটা বলানো হয়েছিল তাঁকে। পার্চমেন্টের শেষ ভাগে আবার নজর ফিরিয়ে নিয়েছেন তিনি:
‘কিন্তু সাবধান, অবিশ্বাসীরা কিন্তু এখানে প্রবেশ করলেই মরবে। প্রভু অ্যানুবিসকে পাশ কাটিয়ে সামনে এগুনো হয়তো সম্ভব হবে, তবে তিনি অনুপ্রবেশকারীকে বাইরের পৃথিবীতে ফেরত যেতে দেবেন না। মনে রেখ অ্যানুবিস এক অদ্ভুত দেবতা যার মধ্যে রয়েছে এক গোপন আত্মা।’
সার রোনাল্ড এই ক’টা লাইন অস্ফুটে খুব দ্রুত পড়ে কাগজটা ভাঁজ করে ফেলেছেন। কিছুক্ষণ পর তিনি আলোচনার মোড় ভিন্ন প্রসঙ্গে ঘুরিয়ে নেন। যেন এই ব্যাপারটাকে ভুলে থাকতে চাইছেন।
পরের সপ্তাহ বাপ-ছেলের কেটে যায় দক্ষিণে অভিযানের জন্য যোগাড়যন্ত্রে। পিটার অবাক হয়ে লক্ষ করে বাবা যেন তাকে কেমন এড়িয়ে চলছেন, একান্ত প্রয়োজন না হলে কথা বলেন না। শুধু ভ্রমণ বিষয়ক আলোচনা হলে দুজনের কথা হয়। কিন্তু পিটার কিছুই ভোলেনি। তার প্রশ্ন বাবা নীরবে সেদিন কী পড়ছিলেন। কেন তাঁর হাত কাঁপছিল, কেনই বা হঠাৎ অন্য প্রসঙ্গে তিনি চলে গিয়েছিলেন। আর পার্চমেন্টটা নিয়ে এত ঢাক ঢাক গুড় গুড় কেন? পাণ্ডুলিপির শেষে যে অভিশাপের কথা বলা হয়েছে আসলে সেটা কী?
পিটারের মাথায় প্রশ্নগুলো কদিন বেশ কুট কুট করে কামড়ালেও ধীরে ধীরে এটার কথা ভুলে যায় সে, অনেকটাই দূর হয় ভয়। ভ্রমণের জন্য দুজনের ব্যস্ততা এত বেড়ে যায় যে অন্য কিছু নিয়ে চিন্তা করার সময় তাদের ছিল না। আসল জায়গায় পৌঁছার পর এলাকাটার নির্জনতা চারদিক থেকে চেপে বসে পিটারকে। আবার ফিরে আসে সেই ভয় এবং দুশ্চিন্তা। সার রোনাল্ড একবার তাকে মিসরীয়দের প্রেততত্ত্বের ওপর কিছু কথা বলেছিলেন, প্রধান ধর্মযাজকদের অনেক আশ্চর্য গল্প শুনেছে সে তার বাবার কাছে। এটা তাদের সেই জন্মস্থান। পিটারের দু’একজন বন্ধুর সবাই অভিশাপের ব্যাপারটি বিশ্বাস করত। এদের প্রত্যেকের মৃত্যু ঘটেছে অদ্ভুতভাবে। এ ছাড়াও রয়েছে তুতানখামেন এবং পট মন্দিরের রোমহর্ষক ঘটনা। গভীর রাতে, তারা জ্বলা আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে এ সব গল্প মনে করত। সামনে তার জন্য না জানি কী বিপদ ওত পেতে আছে ভেবে শিউরে উঠত তারপর, মানচিত্রে চিহ্নিত নির্দিষ্ট জায়গায় সার রোনাল্ড তাঁবু বসালে নতুন আরেক অশুভ সঙ্কেতের সূচনা হয়।
আস্তানা গাড়ার প্রথম রাতেই সার রোনাল্ডকে তাঁবুর পেছনের দিকের পাহাড়ে একা যেতে দেখে কৌতূহলী হয়ে ওঠে পিটার। বাবার হাতে রশি বাঁধা একটি সাদা ছাগল এবং মস্ত ধারাল ছুরি দেখে সন্দেহ আরও বেড়ে যায় তার। পিছু নেয় সে। তারপর ঘটে সেই ঘটনা। ছাগলটি জবাই করেন সার রোনাল্ড। অবোধ পশুটার ফিনকি ছোটা রক্ত মুহূর্তে শুষে নেয় শুকনো বালু। বাবার চোখে তখন কসাইদের উৎকট উল্লাস।
একটি ঢিবির আড়ালে লুকিয়ে থেকে পিটার শোনে বাবা দুর্বোধ্য উচ্চারণে মিসরীয় স্তোত্র আউড়ে চলেছেন। পিটার ভয় পাচ্ছিল ভেবে বাবা তার উপস্থিতির কথা জেনে গেলে হয়তো আর তাকে সঙ্গে নিতে রাজি হবেন না। তবে বাবার আচরণে কেমন ক্ষ্যাপামো একটা ভাব তাকে অস্বস্তিতে ফেলে দেয়।
কিন্তু বাবার কাছে বলি বলি করেও সে জিজ্ঞেস করতে পারছিল না। পার্চমেন্টের সেই রহস্য নয়, গোপন ‘অভিশাপ’ নিয়ে।
মাঝরাতের ওই ঘটনার পর দিন সার রোনাল্ড চার্ট দেখে বলেন এখন খনন শুরু করা চলে। ম্যাপে চোখ রেখে, বালিতে প্রতিটি পা মেপে তিনি তাঁর লোকদের কাজ চালিয়ে যেতে বলেছেন। সন্ধ্যার দিকে দশ ফুট ব্যাসার্ধের বিরাট একটি গর্ত খোঁড়ার কাজ শেষ হয়ে যায়, যেন হাঁ করে আছে কোনও দানব মুখ। খনন পর্ব শেষ হতেই স্থানীয় শ্রমিকরা উল্লসিত চিৎকার দিয়ে জানায় গর্তের নীচে একটি দরজা দেখতে পেয়েছে তারা।