যেতে যেতে ক্রামার বার কয়েক চেষ্টা করল তার ভিশন সেটটাকে ঠিক করতে। একবার প্রায় ঠিক হয়ে এসেছিল কিন্তু পরক্ষণে ঝাপসা হয়ে গেল ছবি, তারপর কন্ট্রোল থেকে আর সাড়াশব্দই এল না। কাঁধের যন্ত্রণাটা আবার ফিরে এসেছে, বাঁ হাতটা অবশ ঠেকছে। ক্রামার টের পেল বগলের নীচের গ্ল্যান্ড ফুলে উঠেছে।
দুপুরের দিকে ক্রামার লক্ষ করল চারপাশের দৃশ্যপটের খানিকটা পরিবর্তন হয়েছে। ক্যানালের দেয়ালগুলো যেন আরও গভীর, আরও চেপে আসছে। বড়বড় পরিখাগুলোর রঙ টকটকে লাল, ঝলসে দিচ্ছে চোখ।
হঠাৎ থমকে দাঁড়াল ক্রামার, চোখ বড় হয়ে গেল বিস্ময়ে। সিকিমাইল দূরে ওর পথ রোধ করে দাঁড়িয়েছে কালো রঙের বিশাল এক পাথরের ঢিবি।
পাহাড়! কাছে যেতেই বড়বড় বোল্ডারগুলো স্পষ্ট দেখতে পেল ক্রামার, একটার ওপর আরেকটা স্তূপ হয়ে আছে, কেমন ভয় ধরানো একটা ভাব আছে ওগুলোতে। এগুলো এখানে এল কোত্থেকে? ক্যানালের মাথার ওপর দিয়ে নিশ্চয়ই গড়িয়ে আসেনি, আর শিলাস্তূপের আকৃতিটা এত নিখুঁত যে ক্রামারের বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করল না এটা প্রকৃতির কোনও সৃষ্টি।
সাবধানে আগে বাড়ল ক্রামার। বিশ গজ দূরত্ব থাকতে সে আবার দাঁড়িয়ে পড়ল, ভয়ের একটা ঢেউ ওকে নাড়া দিয়ে গেল। পাথরগুলোর মধ্যে জ্যান্ত কী যেন একটা আছে। ভয়ঙ্কর দৃষ্টিতে ওর দিকে যেন তাকিয়ে আছে পাথরগুলো।
হঠাৎ গলা চিরে ভয়ার্ত একটা চিৎকার বেরুল ক্রামারের, ঘুরেই দৌড় দিল। দৌড়াতে দৌড়াতে এক সেকেন্ডের জন্য পেছন ফিরে চাইল ও, অবিশ্বাস্য দৃশ্যটা দেখে ছানাবড়া হয়ে গেল চোখ। ‘পাথরগুলো’ ঢিবি থেকে নেমে এসেছে, ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল শক্ত মাটিতে। ধীরে, তবে নির্ভুল নিশানায় ওকে অনুসরণ শুরু করল ‘ওরা’।
ক্রামারের চকিতে মনে পড়ে গেল কথাটা। বুঝতে পারল কীসের পাল্লায় পড়েছে। গ্র্যান্ড ক্যানালের মূর্তিমান আতঙ্ক ওগুলো-ক্যানালৱাস।
প্রথমদিকে সহজেই দৌড়ে ওদের পেছন ফেলে দিল ক্রামার। কিন্তু ওরাও গতি বাড়ালে দিশেহারা বোধ করল সে। বালির ওপর দিয়ে গড়িয়ে আসছে ক্যানাব্রাসেরা, যেন ওজন শূন্য। পেছন ফিরলেই ওগুলোর গুহার মত মুখ আর অসংখ্য চোখ দেখতে পাবে ভেবে ওদিকে তাকাল না ক্রামার।
ওদের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছে সে। ক্যানালব্রাসরা অজৈব, তবে সর্বভুক। ওরা জৈব পদার্থ বা প্রাণী থেকে খাবার সংগ্রহ করে। কিন্তু মাটির ওপর এমনভাবে পড়ে থাকে যেন কয়লার একটা ডিপো।
ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াচ্ছে ক্রামার। কীভাবে দানবগুলোর হাত থেকে নিস্তার পাবে জানে না। হঠাৎ অনেকদিন আগে একটা বইতে পড়া তথ্যটা মনে পড়ে গেল ওর। ক্যানালব্রাসরা সব-সনিক কম্পন সহ্য করতে পারে না। একমাত্র এই জিনিসটাই ওদের ঠেকিয়ে রাখতে পারে। কিন্তু ক্রামারের কাছে এই মুহূর্তে ভাইব্রেটর নেই, তবে হিট পিস্তল আছে। উন্মাদের মত হোলস্টার থেকে একটানে অস্ত্রটাকে বের করল ক্রামার, ঘুরে দাঁড়াল, এবং গুলি করল।
রেজাল্ট কী হবে জানা ছিল না ক্রামারের। নল থেকে আগুনের একটা ঝলক বেরুল্ শুধু, যেন ঝাঁকি খেয়ে থেমে গেল ক্যানালব্রাসদের দলটা। স্নো মোশন ছবির মত একসঙ্গে ঘুরে গেল সব ক’টা, রণেভঙ্গ দিল। আগের জায়গায় ফিরে গেল ওরা, একটা আরেকটার ওপর চড়ে বসল, ঠিক আগের পজিশনে ফিরে গেল কয়েক মিনিটের মধ্যে।
অনেকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল ক্রামার, এখনও যেন বিশ্বাস করতে পারছে না একটু আগের ঘটনাটাকে। তারপর সাহসের সঙ্গে পরীক্ষাটা করল।
ক্রামারের হিট পিস্তলটা লেটেস্ট গান-লারকিটন টাইপের, বিদ্যুৎপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণের ছোট্ট যন্ত্রটা কম্পন নিয়ন্ত্রণে ওস্তাদ। খুব কম অস্ত্রেই সুপার-সনিক চার্জ থাকে। ক্রামারের পিস্তলটা সেগুলোর মধ্যে একটা।
সাব-সনিক চার্জ দিয়ে যদি ক্যানালব্রাসদের সাময়িকভাবে স্থির করে দেয়া যায়, তা হলে সুপার-সনিক কিংবা আলট্রা-সনিক ওয়েভ দিয়ে ওদের সচল করা কি সম্ভব নয়?
সেই চেষ্টাই চালাল ক্রামার, অস্ত্রটা অ্যাডজাস্ট করল, গুলি ছুঁড়তেই পাথুরে আকৃতিগুলো যেন জীবন ফিরে পেল। সাব-সনিক আগুনের একটা গোলা ওদেরকে আগের মত আগ্রাসী হামলা চালানোর পর্যায়ে নিয়ে গেল।
আবিষ্কারের আনন্দে একটা সিগার ধরাল ক্রামার। পনেরো মিনিটের মধ্যে সে তৃতীয় ফাঁদটা পাতল। যদিও এই ফাঁদ পাতার কোনওই দরকার ছিল না। কিন্তু কোন রকম ঝুঁকি নিতে রাজি নয় ক্রামার ি
হিট গানটা বালুতে পুঁতল সে, শুধু ব্যারেল আর ট্রিগারটা বেরিয়ে থাকল। একটা দড়ি শক্ত করে আড়াআড়ি বাঁধল ক্যানাল ফ্লোরের বিশগজ জায়গা জুড়ে। দড়ির একটা গিঁট বাঁধা থাকল ট্রিগারের সঙ্গে। ব্যারেলটা সোজা তাক করে রাখল ক্রামার ক্যানাব্রাসদের দিকে।
‘এখন,’ বিড়বিড় করে বলল সে, ‘যদি এই পথে ব্ল্যান র্ড ওয়ে স্টেশনের দিকে আসে তা হলে সে মস্ত একটা সারপ্রাইজ পাবে। আসলে আজকালকার যুগে মস্তিষ্ক না থাকলে কোনও কাজ করা সম্ভব না। ‘
আত্মতুষ্টিতে বলীয়ান ক্রামার জ্যান্ত পাথরগুলোকে পেছনে রেখে লম্বা পায়ে ক্যানালের দিকে এগোল।
সিকি মাইল এগোবার পর ও চুরি করা ম্যাপটা বের করে চোখ বোলাতে লাগল। ম্যাপ আঁকা বইটা হাতে নিয়ে চারদিকে লক্ষ করতে করতে হাঁটতে লাগল।