ক্লেটন সোজা গিয়ে বাধা পড়ল তার সহকারী জেরী চেজের আলিঙ্গনের মধ্যে। চেজ বিস্মিত দৃষ্টিতে ক্লেটনের অসম্ভব রোগা, নিস্তেজ চেহারার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনি কে? মি. ক্লেটন কোথায়?’ তারপর ভাল করে মুখের দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠল সে। ‘আ…হায়…মি. ক্লেটন…। কিন্তু আপনার একী দশা, সার? আপনি যখন যাত্রা শুরু করলেন তখনই বিস্ফোরণটা ঘটল। স্পেসশিপ এই জায়গা ছেড়ে নড়তেই পারেনি। কিন্তু ভয়ানক কাঁপছিল বলে আপনাকে উদ্ধার করতে যেতে পারছিলাম না আমরা। এই একটু আগে কাঁপুনি থেমেছে। কিন্তু আপনার কী হয়েছে, সার? এমন লাগছে কেন আপনাকে?’
ফ্যাকাসে নীল চোখ জোড়া খুলে গেল ক্লেটনের। কথা বলার সময় ঝাঁকি খেল শরীর, ফিসফিসিয়ে অস্ফুটে বলল, ‘আ-আমি সময়ের হিসেব হারিয়ে ফেলেছিলাম, কত-কতদিন আমি ফিউচারে ছিলাম?’
বৃদ্ধ লোকটির মুখের দিকে তাকিয়ে জেরী চেজের মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। আস্তে করে বলল, ‘মাত্র এক সপ্তাহ; সার।’
আস্তে চোখ দু’টো বন্ধ হয়ে এল, সামান্য কেঁপে স্থির হয়ে গেল দেহটা। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছে রিচার্ড ক্লেটন তার অশুভ যাত্রার সমাপ্তি ঘটিয়ে।
শূন্য
সিঁড়ির সর্বোচ্চ ধাপে একঠায় অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল ক্রামার, কিছু শোনার চেষ্টা করল, তার পেছনের রাস্তাটা খালি এবং নির্জন, মিশে গেছে দিগন্তরেখার সাথে। যেন কার্ডবোর্ডের ওপর চকখড়ির একটা হালকা দাগ। মাথার ওপরে শুকনো, স্থির বাতাসে নিঃসঙ্গ একটা কিলোটা চক্কর দিচ্ছে, খুঁজছে শিকার। নেই, ওকে কেউ অনুসরণ করার কোনও চিহ্ন নেই।
ক্রামার ওর জিনিসপত্রগুলো আবার চেক করল: ক্যান্টিন, খাবারের ট্যাবলেট, স্যান্ড মাস্ক, আর সবচে’ মূল্যবান বস্তুটি-ম্যাপ। ছোট অয়েলস্কিন থলের মধ্যে রাখা প্রাচীন ম্যাপটার দিকে চোখ বুলাতেই রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল সে।
সোমবার। সকাল ১১:১৪। ঘড়ি দেখল ক্রামার। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ঠিক এগারো দিনের দিন সে ‘ক্যানাল টোয়েন্টি এইট নর্থ ওয়েস্ট’-এ পৌঁছুবে। তারপর আর অসুবিধে নেই। জাল পাসপোর্ট দেখিয়ে সহজেই ক্রেটার সিটি পোর্টে ঢুকে যাবে ক্রামার। প্রতিদিন দুপুরের নিয়মিত ‘আর্থ এক্সপ্রেস’-এ চড়ে সে পগার পার হবে। রানচার্ডের বাপেরও সাধ্য নেই বুঝতে পারে ওই পথে সে পালিয়েছে। মাসখানেক আগে যখন প্ল্যানটা করল ক্রামার তখনই প্রতিটি ডিটেইল সে পরীক্ষা করেছে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে, ঘড়ির কাঁটা ধরে এগিয়েছে সমস্ত কাজ।
সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করল ক্রামার, আনমনে গুণছে: ছাপ্পান্ন, সাতান, আটান্ন। লেভেল ওয়ান। কালের আঁচড়ে মলিন, অস্পষ্ট সাইনবোর্ডটা হঠাৎ চোখে পড়ল
এই খালে প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ
আদেশক্রমে
জারা
নামটা পড়ে অবাক হলো ক্রামার। জারা, ইতিহাস বইতেই শুধু এই নামটা দেখেছে সে। জারা, মার্শিয়ান রাজত্বের শেষ সম্রাট, বিস্মৃত হয়েছে কবে। ক্রামার মনে করার চেষ্টা করল তৃতীয় নাকি চতুর্থ সম্রাটের সময় এই খালগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
একশো আটাশ, একশো ঊনত্রিশ। তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম লেভেল। আরেলিয়াম স্টীলের তৈরি প্রকাণ্ড এক দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল ক্রামার। টর্চের আলোতে দ্বিতীয় সাইনবোর্ডটা যেন ভেঙচি কাটল ওকে:
এই খালে প্রবেশ সম্পূর্ণ…
পকেট থেকে একটা চাবি বের করল ক্রামার। খুব সাবধানে রাজকীয় সীলটা তুলল, চাবি তালায় ঢুকিয়ে মোচড় দিল। আস্তে খুলে গেল দরজা।
ভেতরে ঢুকল ক্রামার। সতর্কতার সাথে সীলটাকে আবার আগের জায়গায় লাগাল। ওর অনুপ্রবেশের কোনও চিহ্নই আর থাকল না। নিঃশব্দ হাসিতে ভরে উঠল ক্রামারের মুখ।
ক্যানাল গ্র্যান্ড-উত্তর আর দক্ষিণ মঙ্গলগ্রহের মধ্যে যোগসূত্রতার প্রধান ধমনী। ক্যানাল গ্র্যান্ড মিশেছে শূন্যে, ওর পলায়নের উৎকৃষ্ট পথ। ক্রামার জানে পৃথিবীর কোনও মানুষ কিংবা মার্শিয়ান কখনও শূন্যে অভিযানে বেরোয়নি, ওখানে গেলেও কেউ ফিরে আসেনি কোনওদিন। শূন্য যেন এক বিশাল দানব। গ্রাস করে সবাইকে। আজও শূন্যকে নিয়ে বহু গল্পকথা প্রচলিত, বেশিরভাগই হয়তো কুসংস্কার থেকে উদ্ভূত, কিন্তু এটা ঠিক শূন্যে এ পর্যন্ত যে-সব অভিযান চালানো হয়েছে, পাঠানো হয়েছে রকেট শিপ, প্লেন ইত্যাদি-কোনটারই আর সন্ধান মেলেনি। শূন্য, একা এবং বিশাল, লাল রঙের গ্রহটাকে দুই ভাগে ভাগ করে অবিচল দাঁড়িয়ে আছে।
দ্রুত সামনে পা বাড়াল ক্রামার। ওর পরনে গরম, আরামদায়ক স্পেসসুট, মাথায় হেক্সটার হেলমেট। হাঁটতে হাঁটতে খালের মাঝখানে চলে এল। মাটি এখানে শক্ত, ফুটপাথের মত সমতল। দু’পাশের দেয়ালগুলো উঁচু এবং অন্ধকার।
হাঁটতে হাঁটতে ভাবছে ক্রামার। ভাবছে মানুষের জীবনে কত অদ্ভুত ঘটনাই না ঘটে। মাসখানেক আগেও সে ফাগান্ডা-র মেট্রোপলিটান পাওয়ার ইউনিটের সাধারণ একজন রেশিও ক্লার্ক ছিল। ছকে বাঁধা জীবনটা ছিল একঘেয়ে। মাঝে মধ্যে দু’একটা চুরিচামারির ঘটনা খানিকটা উত্তেজনার খোরাক যোগাত। তারপর একদিন হঠাৎ করেই প্ল্যানটা মাথায় এল ওর।
প্ল্যানটা করেছিল সে শূন্যের গোপনীয়তা জানার জন্য, যে গোপনীয়তা সহস্র বছর ধরে মানব জাতিকে হতবুদ্ধি করে রেখেছে। ৩০৯১ সালে ইতিহাসবিদ স্টোলা লিখেছিলেন: