কিন্তু এ ওঠার যেন কোন শেষ নেই। উঠছে তো উঠছেই। সেই সাথে ধাতব পায়ের একটানা আওয়াজ উঠছে-ঢং, ঢং, ঢং। ধাতব মুখ কখনও ঘামে না। ধাতব মানুষ কখনও ক্লান্ত হয় না কিন্তু ক্লেটন তো ধাতব নয়, রক্তমাংসের মানুষ। প্রচণ্ড হাঁফিয়ে গেছে সে, ক্লান্তিতে ভেঙে পড়তে চাইছে শরীর। তবু তাকে টেনে নিয়ে চলল দানবগুলো। দীর্ঘসময় পরে অবশেষে শেষ হলো উত্থানপর্ব। চুড়োয় উঠে টাওয়ার রুমের ভেতরে ওরা ছুড়ে ফেলল তাকে। তারপর তাদের ধাতব কণ্ঠ খনখন করে উঠল, গ্রামোফোনের ভাঙা রেকর্ডের মত।
‘হে-প্রভু-তাকে—আমরা একটা পাখির মধ্যে পেয়েছি।’
‘তার-শরীর-নরম-বস্ত্র-দিয়ে-তৈরি।’
‘সে কোনও-আশ্চর্য-উপায়ে-বেঁচে আছে।’
‘সে-একটা-প্রাণী।
তারপর একটা গুমগুম শব্দ উঠে এল টাওয়ার রুমের মাঝখান থেকে।
‘আমি ক্ষুধার্ত।’
মেঝে থেকে অকস্মাৎ উদয় হলো একটা লোহার সিংহাসন। এ হলো ধাতব দানবদের প্রভু। জিনিসটা বিরাট আকৃতির লোহার একটা চোরাগত। গর্তের চারদিকে ঘিরে আছে বেলচা আকৃতির ভয়ঙ্কর দু’টো চোয়াল। চোয়াল দুটো ক্লিক করে ফাঁক হয়ে গেল, ঝকমক করে উঠল ক্ষুরধার দাঁতের সারি। গর্তের গভীর থেকে গমগমে কণ্ঠটা ভেসে এল, ‘আমাকে খেতে দাও।’
ধাতব দানবরা ক্লেটনকে ধরে ছুঁড়ে মারল সেই হাঁ করা বিশাল গর্তের মধ্যে। বিশাল চোয়াল দুটো তৎক্ষণাৎ সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল, তীক্ষ্ণধার দাঁতগুলো বসে গেল মাংসল দেহে…
.
প্রচণ্ড চিৎকার করে জেগে উঠল ক্লেটন। কাঁপা হাতে আলো জ্বালল, তাকাল আয়নায়। ওর বেশিরভাগ চুল সাদা হয়ে গেছে। আগের চেয়েও বুড়ো দেখাচ্ছে। ক্লেটন অবাক হয়ে ভাবল এভাবে একটার পর একটা দুঃস্বপ্নের ধাক্কা ওর মস্তিষ্ক আর কত সইতে পারবে।
ফুড ক্যাপসুল খাওয়া, কেবিনে হাঁটাহাঁটি, একঘেয়ে শব্দটা শোনা, আর বাঙ্কে শুয়ে পড়া-ব্যস, এ ছাড়া আর কিছু নেই রিচার্ড ক্লেটনের জীবনে, আর শুধু বসে বসে অপেক্ষার প্রহর গোনা। এভাবে কতযুগ অপেক্ষার প্রহর গুনতে হবে জানে না সে।
দিনের পর দিন চলে যাচ্ছে-দিনের হিসেব রাখে না ক্রেটন। আর ঘোরের মধ্যে একটার পর একটা দুঃস্বপ্ন দেখে যেতে লাগল। প্রতিটি দুঃস্বপ্নের পর জেগে উঠে আতঙ্কিত চোখে সে লক্ষ করে বয়স আরও বেড়ে গেছে তার। শরীর দুর্বল হয়ে পড়ছে দ্রুত। কখনও কখনও সে ভীত হয়ে ভাবে যাত্রা শুরুর আগে যে হিসেব নিকেশ সে করেছিল তাতে নিশ্চয়ই মারাত্মক কোনও ভুল থেকে গিয়েছিল। হয়তো সে সৌরমণ্ডলের চারদিকেই ক্রমাগত ধীর গতিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। হয়তো সে জীবনেও মঙ্গলে পৌঁছুতে পারবে না। পরক্ষণে মনে অশুভ চিন্তাটা খেলে যায়-যদি এমন হয়, সে মঙ্গলও পার হয়ে এসেছে, সৌরজগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এখন মহাশূন্যের অনির্দিষ্ট গন্তব্যে ছুটে বেড়াচ্ছে!
চিন্তা করতে করতে মাথা গুলিয়ে আসে ক্লেটনের। আর ভাবতে পারে না সে, ক্যাপসুল খেয়ে শুয়ে পড়ে বাঙ্কে। মাঝে মাঝে পৃথিবীর কথা মনে পড়ে তার, শঙ্কিত হয়ে পড়ে। পৃথিবী কি এখনও বেঁচে আছে? অস্তিত্ব লোপ পায়নি তো তার? এমনও হতে পারে পারমাণবিক যুদ্ধে পুরো পৃথিবী এক বিরাট ধ্বংস্তূপে পরিণত হয়েছে। অথবা বিরাট কোনও উল্কার আঘাতে শেষ হয়ে গেছে সাধের ধরিত্রী। কিংবা এমনও ঘটা বিচিত্র নয় নক্ষত্রলোক থেকে ছুটে আসা মৃত্যুরশ্মির আঘাতে ধ্বংস হয়ে গেছে দুনিয়া। ভয়াবহ সব আশঙ্কা ঘিরে রাখে ক্লেটনকে। কখনও ভাবে গ্রহান্তরের প্রাণীরা পৃথিবী দখল করে নেয়নি তো? কিন্তু এসব তার ক্ষণিকের ভাবনা। সবসময় তার মন জুড়ে থাকে কীভাবে, কবে সে তার লক্ষ্যে পৌছুবে। স্বপ্নের মঙ্গলকে না দেখে মরেও তো শান্তি পাবে না সে। তাকে বেঁচে থাকতেই হবে।
এমনি করে কেটে যেতে লাগল সময়। ক্লেটনের প্রায়ই মনে হত স্পেসশিপের বাইরে থেকে কারও যেন কণ্ঠ ভেসে আসছে। মহাশূন্যের বিকট অন্ধকার থেকে ভেসে আসছে ভৌতিক আর্তনাদ। দুঃস্বপ্নেরা ফিরে ফিরে এল তার কাছে। এরমধ্যে কতদিন, কতঘণ্টা পেরিয়ে গেছে জানে না ক্লেটন। কিন্তু যখনি আয়নার দিকে তাকায়, ক্লেটন দেখতে পায় তার বয়স আরও দ্রুত বেড়ে চলছে। চুল বরফের মত সাদা, মুখ ভরে গেছে বলিরেখায়। সুস্থভাবে কিছু চিন্তা করারও শক্তি পাচ্ছে না সে। স্পেসশিপের একঘেয়ে, যন্ত্রণাদায়ক কাঁপুনি ও শব্দের মধ্যে মড়ার মত পড়ে আছে সে। কিন্তু এখনও বেঁচে আছে।
.
ঘটনাটা যে কী ঘটল প্রথমে ভাল করে বুঝতে পারেনি ক্লেটন। চোখ বুজে নিশ্চল শুয়েছিল সে। হঠাৎ অনুভব করল অবিশ্রাম কাঁপুনিটা আর নেই। অবিশ্বাস্য ব্যাপার! ক্লেটন ভাবল, এবারও সে নির্ঘাত স্বপ্নই দেখছে। চোখ ঘষতে ঘষতে কোনমতে বিছানায় উঠে বসল ক্লেটন। ভাল করে তাকিয়ে বুঝল না, ফিউচার নড়ছে না। নিশ্চয়ই সে ল্যান্ড করেছে।
ফিউচারের কম্পন থেমে গেলেও ক্লেটনের শরীরের কাঁপুনি থামেনি। বছরের পর বছর একাধারে কম্পনের ফল এটা। উঠে দাঁড়াতে ভয়ানক কষ্ট হলো ক্লেটনের। কিন্তু এখন যে তাকে উঠতেই হবে। সময় এসেছে। এ মুহূর্তটির জন্য সে এতগুলো বছর অপেক্ষা করেছে। তার স্বপ্ন এখন সফল হয়েছে। তার ফিউচার ল্যান্ড করেছে। অসম্ভবকে সম্ভব করেছে সে।
টলতে টলতে দরজার দিকে এগোল ক্লেটন। দরজার হাতলটা প্রবল উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে ওপরের দিকে তুলল। খুলে গেছে দরজা। ঝকঝকে সূর্যের আলো এসে চোখে বাড়ি মারল। শরীর ছুঁয়ে গেল বাতাস। আলোতে চোখ যেন ঝলসে গেল ক্লেটনের। বুক ভরে শ্বাস টানল-পা বাড়াল বাইরে-