সময় যাবার সাথে সাথে সবকিছুর একটা রুটিনও স্থির হয়ে গেল। অভ্যাসমত পায়চারী করছে ক্লেটন। ক্লান্ত হয়ে পড়লে ক্যাপসুল খেয়ে শুয়ে পড়ছে। এক সময় ঘুমিয়েও পড়ছে, ঘুম থেকে জেগে আবার পায়চারী করছে।
রিচার্ড ক্লেটন ধীরে ধীরে পরিবেশ এবং নিজের শরীর সম্পর্কে বিস্মৃত হয়ে যেতে লাগল। মাথার ভেতর একঘেয়ে শব্দটা যেন ওর শরীরেরই একটা অংশ হয়ে উঠল। আর এই শব্দটাই যেন ওকে জানান দিয়ে চলল সে একটা স্পেসশিপে ছুটে চলেছে মহাশূন্যের পথ ধরে। ক্লেটন এখন আর নিজের সাথে একা একা কথাও বলে না। নিজেকে সে যেন সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়েছে। ওর চোখে এখন একটাই স্বপ্ন—মঙ্গলগ্রহ। স্পেসশিপটা যেন তার প্রতিটি ঝাঁকুনির সাথে একভাবে বলে চলেছে মঙ্গল- মঙ্গল মঙ্গল।
হঠাৎ একটা বিস্ময়কর ঘটনা ঘটল। রিচার্ড ক্লেটন বুঝতে পারল সে ল্যান্ড করতে চলেছে। ফিউচারের নাক নিচু হয়ে গেল, নীচের দিকে কাঁপতে কাঁপতে নামতে লাগল স্পেসশিপ। লালরঙের গ্রহটার সবুজ তৃণভূমির দিকে তার যন্ত্রযান এগিয়ে যাচ্ছে স্বচ্ছন্দ ভঙ্গিতে। ক্লেটন টের পাচ্ছে তার যানের গতি ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে, মঙ্গলের মাধ্যাকর্ষণের টানে ধীরে ধীরে নামছে।
অবতরণ করল ফিউচার। স্পেসশিপের দরজা খুলে ক্লেটন বেরিয়ে এল বাইরে, বেগুনি লাল রঙের ঘাসে আলতো করে পা ফেলল। শরীর বেশ ঝরঝরে আর হালকা লাগল। ঝিরঝিরে বাতাস বইছে। মেঘের আড়াল থেকে উঁকি দেয়া সূর্যালোক পৃথিবীর চেয়ে প্রখর ও উজ্জ্বল লাগল।
কিছু দূরে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে সবুজ বনভূমি। বড় বড় গাছে ঝুলে আছে লাল রঙের রসালো ফল। ক্লেটন জাহাজ ছেড়ে এগোল জঙ্গলের দিকে। কী চমৎকার ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব। ওর খুব ভাল লাগল। ওকে দেখেই যেন সারির প্রথম গাছটি মাটির দিকে ঝুঁকে থাকা ‘হাত’ দুটো তুলে সম্ভাষণ জানাল।
হাত—এখানে গাছেরও হাত আছে! দুটো সবুজ হাত এগিয়ে এল ক্লেটনের দিকে। সাপের মত লম্বা আর মসৃণ হাত দুটো দিয়ে গাছটা ওকে আঁকড়ে ধরল, তুলে ফেলল শূন্যে। শক্ত করে পেঁচিয়ে ধরেছে হাতদুটো। গুঁড়ির সাথে গাছটা চেপে ধরল তাকে। অসম্ভব বিস্ময়ে ক্লেটন দেখল দূর থেকে যেগুলোকে লালরঙের ফল মনে করেছিল সেগুলো আসলে ওদের মাথা। এবং রংটাও পুরোপুরি লাল নয়। বেগুনি ভাব আছে একটা।
বেগুনি লাল রঙের ভয়ঙ্কর মাথাগুলো মরা ছত্রাকের মত চোখ তুলে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে ক্লেটনের দিকে। প্রতিটি মুখে বাঁধাকপির মত ভাঁজ। থকথকে, নরম মাংসপিণ্ডের মত লাগছে দেখতে। বিশাল হাঁ করে আছে সব ক’টা। ক্ষুধার্ত ভঙ্গি। যেন ওকে চিবিয়ে খাবে। হঠাৎ সবুজ হাতগুলো ওকে জ্যান্ত, ঠাণ্ডা গুঁড়ির সাথে আরও শক্ত করে চেপে ধরল, ক্লেটন বিস্ফারিত দৃষ্টিতে দেখল বেগুনি লাল রঙের একটা মুখ-মুখটা দেখতে অনেকটা মেয়েদের মত নড়ে উঠেছে। মুখটা বাড়িয়ে দিচ্ছে চুম্বনের ভঙ্গিতে, যেন আগ্রাসী চুমু খাবে।
ভ্যাম্পায়ারের চুম্বন! রক্তাক্ত, ফাঁক করা ঠোঁট দুটো দেখে ক্লেটনের তাই মনে হলো। মুখটা এগিয়ে আসছে ওর দিকে। ক্লেটন পাগলের মত ধস্তাধস্তি শুরু করল। কিন্তু হাতগুলো ওকে চেপে ধরে রইল। নেমে এল মুখটা ওর মুখের ওপর। চুম্বন করল। প্রচণ্ড ছ্যাঁকা খেল ক্লেটন। মনে হলো কেউ বরফ ঠেসে ধরেছে মুখে। হিমশীতল স্পর্শে হঠাৎ ক্লেটনের দুনিয়া অন্ধকার হয়ে এল।
এ অবস্থা থেকে একসময় জেগে উঠল রিচার্ড ক্লেটন। জেগে উঠেই বুঝতে পারল আসলে স্বপ্ন দেখছিল সে এতক্ষণ। ঘামে ভিজে গেছে সমস্ত শরীর। মুখটা দেখার জন্য বাঙ্ক ছাড়ল। এগিয়ে গেল আয়নার দিকে। তাকাল। ভয়ানক চমকে উঠল। একী দেখছে সে? কাকে দেখছে? নাকি এখনও স্বপ্নই দেখছে!
বৃদ্ধ একটা লোক তাকিয়ে আছে আয়নায়। সারামুখে বলিরেখা, দাড়ির জঙ্গলে প্রায় ঢেকে আছে। ফুলোফুলো গাল ভেতরের দিকে ডেবে গেছে। চোখ দু’টোর অবস্থা সবচে’ ভয়াবহ। চোখ দেখে ক্লেটনের বিশ্বাসই হতে চাইছে না ও দুটো তার নিজের চোখ! কোটরের মধ্য থেকে লাল টকটকে দুটো চোখ অসম্ভব ভয় পাওয়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। হাত দিয়ে মুখটা স্পর্শ করল সে, আয়নার মধ্যে স্পষ্ট দেখতে পেল হাতে নীল নীল শিরা জেগে উঠেছে। মাথার চুল ধূসর। ক্লান্তভাবে সে চুলের মধ্যে আঙুল চালিয়ে দিল।
রিচার্ড ক্লেটন বুড়ো হয়ে গেছে!
কতদিন! কে জানে কত বছর ধরে মহাশূন্যে ভেসে বেড়াচ্ছে সে। নিশ্চয়ই অনেক বছর হবে। নইলে শরীরের এত পরিবর্তন হয় কীভাবে? বর্তমানের এই অস্বাভাবিক জীবনই ওর বয়স বাড়িয়ে দিচ্ছে দ্রুত। এই ভয়াবহ অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য দারুণ ব্যাকুলতা অনুভব করল ক্লেটন। আরও ভয়াবহ কোনও স্বপ্ন দেখার আগেই তাকে এই অশুভ যাত্রা’ শেষ করতে হবে। সময়ের অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য সমস্ত মানসিক এবং দৈহিক শক্তি সংরক্ষণ করে রাখতে হবে। টলতে টলতে বাঙ্কে ফিরে এল ক্লেটন। ভীষণভাবে কাঁপছে। নক্ষত্রলোকের অন্ধকার ভেদ করে ফিউচার তার নিজস্ব গতিতে ছুটে চলল।
হঠাৎ ক্লেটনের মনে হলো বিশাল হাতুড়ি দিয়ে কারা যেন দমাদম দরজায় আঘাত করছে। প্রচণ্ড শক্তিতে বাড়ি মেরেই চলেছে। হঠাৎ এক সময় ভেঙে পড়ল দরজাটা। ভীষণ চেহারার কয়েকটা মূর্তি ঢুকল ভেতরে। ধাতব মূর্তি। ওরা এসেই দু’দিক থেকে ক্লেটনকে বজ্রমুষ্ঠিতে আঁকড়ে ধরে টেনে নিয়ে চলল বাইরে। লোহার মেঝের ওপর দিয়ে নিষ্ঠুরভাবে ওকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে দানবগুলো। ওদের ধাতব পায়ের আওয়াজ উঠছে লোহার মেঝেয়। ইস্পাতের তৈরি বিশাল এক যানের সামনে দানবগুলো নিয়ে এল ওকে। যানটা দেখতে মিনারের মত। লোহার ঘোরানো সিঁড়ি পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে উঠে গেছে ওপরে। ওরা ক্লেটনকে নিয়ে সেই ধাতব সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করল।