ঘুম ভাঙার পর প্রথমেই ক্লেটনের মনে প্রশ্ন জাগল, এখন দিন না রাত। কিন্তু স্পেসশিপের মধ্যে দিনরাত্রির তফাত বোঝার উপায় নেই। এখানে দিনও নেই, রাতও নেই। আছে শুধু স্নায়ুকে যন্ত্রণা দেয়া একঘেয়ে শব্দটা। মস্তিষ্ক কুরে কুরে খাওয়া দুঃসহ শব্দটা। বাঙ্ক ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে ক্লেটন দেখল ওর পা কাঁপছে। টলতে টলতে এগুলো সে কেবিনেটের দিকে। ফুড ক্যাপসুল গিলল কয়েকটা।
আবার বাঙ্কে এসে বসল ক্লেটন। ভীষণ নিঃসঙ্গ লাগছে। পরিচিত অপরিচিত সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন সে এখন। অথচ এখানে করার মত কিছুই নেই। জেলখানার নিঃসঙ্গ কয়েদীদের চেয়েও খারাপ অবস্থা তার। ওরা বরং ওর এই সেলের চেয়ে বড় জায়গায় থাকে, সূর্যের আলো উপভোগ করতে পারে; প্রাণভরে শ্বাস নিতে পারে তাজা বাতাসে। আর দু’একজন হলেও মানুষের দেখাও পায় তারা। কিন্তু তার অবস্থা! সম্পূর্ণ বিশ্ব সংসার থেকে বিচ্ছিন্ন এক গুহাবাসী যেন সে। অদ্ভুত অদ্ভুত সব চিন্তা পেয়ে বসছে ওকে। জীবন্ত কাউকে, কোনও একটা কিছু দেখার তীব্র ব্যাকুলতা অনুভব করছে সে নিজের অন্তরে। সামান্য একটা জ্যান্ত পোকার দেখা পেলেও জীবনের সমস্ত সম্পদ তাকে দিতে পারে এখন ক্লেটন। শুধু একটু প্রাণের স্পন্দন দেখতে চায় ও।
এই লাগাতার একঘেয়ে শব্দ ও অসহ্য ঝাঁকুনি সয়ে যাওয়া, মেঝেতে গুনে গুনে পা ফেলা, ক্যাপসুল খাওয়া আর ঘুমানো ব্যস, এ ছাড়া আর কিছু করার নেই ক্লেটনের। ভাবনাগুলোও যেন কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। একসময় হঠাৎ হাতের নখ কাটার প্রবল ইচ্ছে পেয়ে বসল তাকে। প্রচুর সময় ব্যয় করে কাজটা সারল সে। কিন্তু নখ কেটে কি সময় পার করা যায়? আর কোনও কাজ না পেয়ে সে এবার তীক্ষ্ণ চোখে নিজের জামাকাপড়গুলো পরীক্ষা করে দেখতে শুরু করল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ছোট্ট আয়নাতে নিজের শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখখানা দেখে গেল সে। শরীরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, কেবিনের প্রতিটি জিনিস দেখল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। কিন্তু তারপরও ঘুম আসার মত ক্লান্তি অনুভব করল না।
.
মাথাটা দপদপ করতে লাগল ক্লেটনের। চিনচিনে একটা ব্যথা। মনে হচ্ছে এই জীবনে ব্যথাটা থেকে রেহাই মিলবে না। ঘুম আসছে না, তবুও বাঙ্কে গিয়ে শুলো সে। শুয়ে জোর করে চোখ বুজল। আস্তে আস্তে তন্দ্রার মত এল। কিন্তু ফিউচারের ঝাঁকুনিতে বারবার কেঁপে উঠল শরীর, তন্দ্রার ভাবটা কেটে গেল বারবার, একসময় পুরোপুরি জেগে গেল সে। বাঙ্ক ছেড়ে উঠে আলো জ্বালল ক্লেটন। এবং আতঙ্কিত হয়ে লক্ষ করল সময়জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে সে।
‘সময় হচ্ছে আপেক্ষিক’ বন্ধুরা সবসময় বলত ক্লেটনকে। এখন সে হাড়ে হাড়ে কথাটার সত্যতা টের পাচ্ছে। সময় জানবে, এমন কোনও কিছুই নেই ওর কাছে। না আছে ঘড়ি, না অন্যকিছু। এমনকী চাঁদ কিংবা সূর্যের চেহারা দেখারও কোনও উপায় নেই। কতসময় ধরে এই স্পেসশিপে আছে সে? প্রাণপণে চেষ্টা করল ক্লেটন মনে করতে। কিন্তু পারল না।
আচ্ছা সে কি প্রতি ছয় ঘণ্টা অন্তর খাবার খেয়েছে নাকি দশ ঘণ্টা অন্তর? অথবা বিশ ঘণ্টা পরপর? প্রতিদিন কি সে একবার করে ঘুমিয়েছে নাকি তিন অথবা চারদিনে মাত্র একবার ঘুমিয়েছে? সে ক’বার হাঁটাহাঁটি করেছে মেঝেতে?
ব্যাপারটা খুব ভয়াবহ। সে যদি সত্যি সত্যি সময়ের হিসেব গুলিয়ে ফেলে তা হলে তো মহাসর্বনাশ হবে। এই মহাশূন্যে, স্পেসশিপে যেখানে অজানার উদ্দেশে উড়ে চলেছে, সেখানে তো সে অচিরেই পাগল হয়ে উঠবে। একা, এই ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠে তাকে কিছু না কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকতেই হবে। আবার ভাবনটা ফিরে এল ওর মধ্যে।
এখন সময় কত?
কিন্তু এই পাগল করা চিন্তা নিয়ে আর ভাবতে চায় না ক্লেটন। সে এখন অন্যকিছু ভাবতে চায়,। অন্য কিছু নিয়ে ব্যস্ত থাকতে চায়। যে পৃথিবী ছেড়ে ও চলে এসেছে সেই দুনিয়া এখন সে ভুলে থাকতে চায়। নয়তো পেছনের স্মৃতি ওকে আরও চরমে পৌছে দেবে।
‘আমি ভয় পাচ্ছি,’ ফিসফিস করে বলল ক্লেটন। ‘মহাশূন্যের এই অন্ধকারে একা থাকতে ভয় লাগছে আমার। হয়তো আমি এতক্ষণে চাঁদকে পেছনে ফেলে এসেছি। হয়তো পৃথিবী থেকে এখন দশ লক্ষ মাইল দূরে চলে এসেছি।
ক্লেটন হঠাৎ বুঝতে পারল, নিজের সাথে একা একা কথা বলে চলেছে সে। পাগলামির লক্ষণ! তবুও কথা বলে যাবে সে। থামবে না। এভাবে কথা বলে অন্তত ওর চারপাশ ঘিরে থাকা ভয়ঙ্কর গুঞ্জনের হাত থেকে কিছুটা হলেও রক্ষা পাবে।
‘আমি ভয় পাচ্ছি’ ক্লেটনের ফিসফিসানি ছোট্ট ঘরটিতে যেন প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে এল। আমি ভীষণ ভয় পাচ্ছি। আচ্ছা, এখন কটা বাজে? একনাগাড়ে এভাবে কথা বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে পড়ল ক্লেটন। চোখ বুজে এল। আবার ঘুমিয়ে পড়ল।
ঘুম ভাঙলে নিজেকে বেশ তাজা মনে হলো তার। ‘আমি আসলে হঠাৎ রোধশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলাম,’ আপন মনে বলল সে। আসলে স্পেসশিপের ক্রমাগত, একঘেয়ে শব্দটা ওর স্নায়ুগুলোকে প্রচণ্ড নাড়া দিয়ে গেছে। ভেতরের অক্সিজেনের চাপে ওর মাথা ঝিমঝিম করছে, হতবুদ্ধি মনে হয়েছে নিজেকে। হয়তো ক্যাপসুলগুলো প্রয়োজনের তুলনায় বেশিই খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে শরীর আর দুর্বল ঠেকছে না তার। হাসি ফুটল ক্লেটনের মুখে। পায়চারী শুরু করল মেঝের ওপর। আর পায়চারী করতে করতে সেই ভাবনাটা আবার পেয়ে বসল তাকে। আজ কী বার? যাত্রা শুরুর পর ক’সপ্তাহ কেটেছে? হতে পারে এক মাস চলে গেছে; কিংবা একবছর অথবা দু’বছর? পৃথিবী থেকে অনেক দূরে নিশ্চয়ই এসে পড়েছে সে? কেমন জানি স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হচ্ছে সবকিছু। ক্লেটনের মনে হলো ওর ফিউচার এখন মঙ্গলগ্রহের কাছাকাছি চলে এসেছে। পেছনের কথা বাদ দিয়ে সামনে কী ঘটতে পারে তাই নিয়ে ভাবতে লাগল ক্লেটন।