স্পেসশিপটা নড়ছে এখনও। ভয়ঙ্কর কাঁপুনিটা কমেনি একটুও। কন্ট্রোল প্যানেলের দিকে তাকাতেই দুঃখ, বিস্ময় এবং হতাশায় চোয়াল ঝুলে পড়ল তার। ঈশ্বর! প্যানেলটা গেছে। অস্ফুটে বলল ক্লেটন। প্রচণ্ড ধাক্কায় কন্ট্রোল প্যানেলটার কোনও অস্তিত্বই নেই। ভেঙেচুরে শেষ। ভাঙা কাঁচ পড়ে আছে মেঝেতে। ডায়ালগুলো প্যানেলের নগ্নমুখে এদিক-ওদিক ঝুলছে।
ক্লেটন হতাশ হয়ে বসে রইল ওখানেই। এরচে’ করুণ অবস্থা আর কী হতে পারে? তার ত্রিশ বছরের স্বপ্ন এভাবে ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে তারই সামনে। দশ বছর বয়স থেকেই সে স্বপ্ন দেখে এসেছে একটা স্পেসশিপ তৈরি করবে, উড়ে যাবে অনন্ত অম্বরে। সেভাবেই নিজেকে গড়ে তুলেছিল ক্লেটন। কোটিপতি বাপের একটা পয়সাও এদিক-সেদিক করেনি। স্পেসশিপ তৈরি করার স্বপ্ন সফল করার জন্য প্রচুর পড়াশোনা করেছে, রাশানদের সাথে বন্ধুর মত মিশেছে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করেছে ওদের রকেটগুলো। প্রতিষ্ঠা করেছে ক্লেটন ফাউন্ডেশন। প্রচুর অর্থ ব্যয় করে ভাড়া করে এনেছে মেকানিক, অঙ্কশাস্ত্রবিদ, জ্যোতির্বিদ, প্রকৌশলী এবং শ্রমিক। দিনের পর দিন অক্লান্ত পরিশ্রমের পর অবশেষে তৈরি হয়েছে তার স্বপ্নযান ‘ফিউচার’। ছোট্ট, জানালাবিহীন ফিউচারে ভ্রমণের জন্য যা যা প্রয়োজন সবই ছিল। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত এই যানে ছিল অক্সিজেন ট্যাংক, প্রচুর ফুড ক্যাপসুল এবং স্বচ্ছন্দে হাঁটাহাঁটি করার মত ছ’কদম জায়গাও। আর এই ছোট কেবিনটিই হয়ে উঠেছিল তার সকল স্বপ্নসাধ মেটানোর একমাত্র অবলম্বন। ক্লেটন চেয়েছিল ফিউচারে করেই সে স্বপ্নভূমি মঙ্গলগ্রহে পাড়ি জমাবে। সে-ই হবে মঙ্গলগ্রহে পদার্পণকারী প্রথম মানুষ। হিসেব করেও দেখেছে মঙ্গলে যেতে আসতে তার বিশ বছর সময় লাগবে। ঘণ্টায় হাজার মাইল বেগে ছুটবে ওর ফিউচার। সেভাবেই সব ঠিকঠাক করা হয়েছিল। পুরো প্যানেল সিস্টেমটাই করা হয়েছিল স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলার জন্য। কিন্তু শুরুতেই এ কী বিপত্তি!
‘এখন আমি কী করব?’ ক্লেটন ভাঙা কাঁচগুলোর দিকে তাকিয়ে হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। বাইরের পৃথিবীর সাথে তার সকল সম্পর্ক এখন বিচ্ছিন্ন। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে ভাঙা বোর্ডে সে না দেখতে পারবে সময় না দূরত্ব, না বুঝতে পারবে গতি। এই ছোট্ট, বদ্ধ কেবিন ছেড়ে বাইরে যাওয়ার কোনও উপায়ই নেই। এখানেই হয়তো ওকে বছরের পর বছর বসে থাকতে হবে। একা। নিঃসঙ্গ। নিজেকে সে অন্য কাজে ব্যস্ত রাখবে তারও উপায় নেই। পড়ার মত বইপত্র কিংবা খবরের কাগজ নেই, নেই খেলাধুলার সরঞ্জাম। মহাশূন্যের বিশাল গহ্বরে এক কয়েদী যেন সে এখন
পৃথিবী ছাড়িয়ে অনেক দূরে চলে এসেছে রিচার্ড ক্লেটন। পৃথিবীটাকে এখন সবুজ আগুনের একটা গোলার মত লাগছে। দ্রুত তাকে পেছনে ফেলে সামনে এগোচ্ছে ফিউচার। এগিয়ে যাচ্ছে আরেক আগুনের গোলার দিকে—মঙ্গল যার নাম।
ক্লেটন মনশ্চক্ষে স্পষ্ট দেখল মহাশূন্যে ওর উত্থানপর্বের দৃশ্যটি। দেখল কমলা রঙের আগুন জ্বেলে ফিউচার ঘন সাদা ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বুলেটের গতিতে শূন্যে চলেছে। অসংখ্য লোক হাঁ করে দেখছে তার মহাশূন্য যাত্রা। মৌমাছির ঝাঁকের মত ভিড় সামলাতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে ওর সহকারী জেরী চেজ। সবাই অবাক হয়ে দেখছে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে শূন্যে মিলিয়ে গেছে ফিউচার। লোকজন এখন নিশ্চয়ই ওকে নিয়ে আলোচনা করতে করতে ঘরে ফিরছে। কিন্তু কিছুদিন পর ওর কথা তাদের আর মনেও থাকবে না। অথচ তাকে, রিচার্ড ক্লেটনকে, এই উড়োজাহাজেই থাকতে হবে বিশটা বছর।
হ্যাঁ, থাকতে হবে। কোনও বিকল্প নেই। কিন্তু এই কাঁপুনি থামবে কখন? ভাবছে ক্লেটন। কাঁপুনি ইতোমধ্যেই অসহনীয় হয়ে উঠেছে। ফিউচার যখন তৈরি করা হয় তখন এরকম কোনও ভাইব্রেশনের কথা তার কিংবা বিশেষজ্ঞদের কারও মাথাতেই আসেনি। তা হলে নিশ্চয়ই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হত। কিন্তু এই কাঁপুনি যদি আর না থামে? যদি কুড়িটা বছর ধরেই ফিউচার এভাবে কাঁপতে থাকে? ভাবতেই আতঙ্কে হিম হয়ে যায় ক্লেটন।
বাঙ্কে শুয়ে শুয়ে ভাবছে রিচার্ড ক্লেটন। শৈশব থেকে বর্তমান পর্যন্ত ঘটে -যাওয়া প্রতিটি ঘটনা বিশদভাবে মনে পড়ে যাচ্ছে। তবে খুব অল্প সময়ের মধ্যে সব ঘটনা মনে পড়ে যাওয়ায় নিজের ওপরই বিরক্ত হয়ে উঠল সে। ভেবেছিল এভাবে অন্তত কিছুটা সময় পার করা যাবে। এই দীর্ঘ সময় কাটাবে কীভাবে ভাবতেই শিরশির করে ঠাণ্ডা একটা স্রোত বয়ে গেল শিরদাঁড়া বেয়ে।
‘আমি অন্তত ব্যায়ামও তো করতে পারি’ চিৎকার করে বলল ক্লেটন। উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করল। ছ’কদম সামনে, ছ’কদম পেছনে। কিন্তু শিগগিরই একঘেয়ে হয়ে উঠল এ হাঁটাহাঁটি। দীর্ঘশ্বাস ফেলল ক্লেটন। এগোল ফুড-স্টোর কেবিনেটের দিকে। একটা ফুড ক্যাপসুল বের করে মুখে দিয়ে গিলে ফেলল- সংক্ষিপ্ত খাবার। ‘এমনকী খাওয়ার জন্যেও আমাকে সময় ব্যয় করতে হচ্ছে না। স্রেফ মুখে দিয়ে গিলে ফেললেই হলো।’ শঙ্কিত মনে ভাবল সে। ওর মুখ থেকে কখন উবে গেছে হাসি। ফিউচারের কাঁপুনি ওকে যেন পাগল করে ছাড়বে। অস্থির হয়ে সে শুয়ে পড়ল বাঙ্কে, ঘুমাবার চেষ্টা করল। ঘুম এলে হয়তো এই বিশ্রী, একঘেয়ে গুঞ্জন ও কাঁপুনির যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবে। বাতি নিভিয়ে দিল ক্লেটন। চোখ বুজে নিজের বন্দীদশার কথা ভাবতে ভাবতে একসময় ঘুমিয়েও পড়ল।