তা ছাড়া মিসরের প্রায় সব পুরাতত্ত্ব বিজ্ঞানীরই মাথায় কমবেশি একটু ছিট আছে। অবশ্য দিনের পর দিন চাঁদি ফাটানো, মগজ গলিয়ে দেয়া রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে উত্তপ্ত বালু খননের মত বিরক্তিকর এবং একঘেয়ে কাজ আর নেই। মস্তিষ্ক রীতিমত বিদ্রোহ করে। আর মাটির নীচের ড্যাম্প পড়া নিকষকালো কবরগুলোর ভৌতিক আবহ শুকিয়ে দেয় আত্মা। প্রাচীন, ভয়ঙ্কর চেহারার দেবতাদের দিকে তাকানোর ব্যাপারটিও খুব একটা সুখকর নয়, বিশেষ করে বেড়াল মাথার বুবাসিস্ট, নাগ দেবতা সেট এবং সাক্ষাৎ শয়তান আমন-রা পিরামিডের সামনে যেভাবে অতন্দ্র প্রহরীর মত দাঁড়িয়ে থাকে, তাতে এদেরকে অগ্রাহ্য করে পিরামিডের ভেতরে প্রবেশ করার কথা ভাবতে অতি সাহসী লোকেরও বুক কাঁপে। নিষিদ্ধ এই এলাকার বাতাসে মৃত্যুর গন্ধ রক্তে যেন শিহরণ জাগায়, শিরায় শিরায় হেঁটে বেড়ায় কিলবিলে পোকার মত। সার রোনাল্ড শখের বশে কিছুদিন প্রেততত্ত্ব নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেছেন। সম্ভবত এ কারণে ভৌতিক ব্যাপারগুলোর প্রতি অন্যদের চেয়ে তাঁর আকর্ষণ একটু বেশিই। তাই পার্চমেন্টের ম্যাপটা চুরি করতে তিনি দ্বিধা করেননি, যে কোনও মূল্যে এটা যোগাড়ে তিনি ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
এই ম্যাপটি প্রাচীন মিসরের এক সন্ন্যাসীর দখলে ছিল। কিন্তু সন্ন্যাসী মোটেও ভাল লোক ছিলেন না। তিনি প্রেততত্ত্বের ওপর একটি পাণ্ডুলিপি রচনা করেছিলেন। সন্ন্যাসী, বলাবাহুল্য ছিলেন প্রেতপূজারী। সার রোনাল্ড এই পাণ্ডুলিপি খুঁজে পান সন্ন্যাসীর মমির সঙ্গে। তবে লেখাটি তিনি নষ্ট করেননি। ভয় ছিল যদি অভিশাপ নেমে আসে। সার রোনাল্ডের ধারণা যে কোনও কারণেই হোক সন্ন্যাসীর ওপর প্রেত দেবতাদের অভিশাপ নেমে এসেছিল। কারণ মমি করা সন্ন্যাসীর হাত, পা, চোখ কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। যেন নিষ্ঠুর আক্রোশে কেউ হাত আর পা ছিঁড়ে নিয়েছে, উপড়ে ফেলেছে চোখ। তবে এতদিন পরেও ছিন্নভিন্ন লাশে পচন ধরেনি। পশুচামড়ায় লেখা ছিল পাণ্ডুলিপি। প্রাচীন মিসরীয় ভাষা জানেন বলে লেখাটি পড়তে অসুবিধে হয়নি সার বার্টনের। যতই পড়েছেন ততই বিস্মিত হয়েছেন, আগ্রহ বেড়েছে পরের পৃষ্ঠাগুলো পড়ার জন্যে। পড়তে পড়তে জানতে পারেন অন্ধকার রাজ্যের এক পিশাচ দেবতার কবরের কথা। এই দেবতা অশুভ আর ধ্বংসের প্রতীক, আলোর ঘোরতর শত্রু, আঁধারই তার চালিকাশক্তি। পাণ্ডুলিপির মধ্যে সার রোনাল্ড একটি ম্যাপ, একটি চার্ট এবং পিশাচ দেবতার গুহায় পৌঁছার সমস্ত নির্দেশনাও পেয়ে যান।
পিটার বার্টনের মনে আছে সেই রাতের কথা যে রাতে বাবা দুর্বোধ্য ওই পাণ্ডুলিপি ইংরেজিতে অনুবাদ করে ওকে পড়িয়ে শুনিয়েছিলেন। মনে পড়ে বাবার চোখ কী রকম ঝিকমিক করছিল, যেন বুকের ভেতর থেকে উঠে আসছিল কথাগুলো।
‘এবং মানচিত্রের নির্দেশানুযায়ী তুমি দেখতে পাবে সমাধির প্রভুকে যিনি তাঁর উপাসক এবং ধনরত্ন নিয়ে চিরনিদ্রায় শুয়ে আছেন।’
শেষ শব্দটা উচ্চারণ করার সময় উত্তেজনায় সার রোনাল্ডের কণ্ঠ যেন বসে গিয়েছিল।
‘এবং প্রবেশের রাতে তোমাকে অবশ্যই শেয়াল দেবতার উদ্দেশে তিনটে শেয়ালকে উৎসর্গ করতে হবে, এবং তাজা রক্ত খেতে দিতে হবে শুষ্ক বালুকে। তারপর নেমে আসবে অসংখ্য ক্ষুধার্ত বাদুড়, এরা শেয়ালগুলোকে ভক্ষণ করবে এবং রক্ত নিয়ে চলে যাবে অন্ধকার জগতে পিতা সেট-এর উদ্দেশ্যে।’
‘এ স্রেফ কুসংস্কার,’ বলেছিল পিটার।
‘বাজে কথা বলিস না,’ পিটারকে ভর্ৎসনা করেছিলেন সার রোনাল্ড। ‘এই রচনার প্রতিটি জিনিস আমি তোকে ব্যাখ্যা করতে পারি, বোঝাতে পারি। কিন্তু তাতে তোর ক্ষতি ছাড়া লাভ হবে না।’ পিটার আর কিছু না বলে শুনে গেছে। ‘বাইরের চত্বরে আসার পর তুমি দরজাটা দেখতে পাবে, দরজার গায়ে প্রভুর চিত্রাঙ্কিত প্রতীক। প্রতীকটির সপ্তম মস্তকের সপ্তম জিভটি ছুরি দিয়ে খুঁচিয়ে দরজা থেকে ছুটিয়ে আনবে। তারপর খুলে যাবে দরজা এবং সমাধি কক্ষে ঢোকার অধিকার একমাত্র হবে তোমারই। ভেতরের চত্বরে যেতে তোমাকে গুনে গুনে তেত্রিশবার পা ফেলতে হবে, তারপরই তুমি সোজা গিয়ে উপস্থিত হবে অ্যানুবিসের মূর্তির সামনে। যার আরেক নাম পথপ্রদর্শক।
‘অ্যানুবিস! এটা মিসরীয়দের এক দেবতার নাম না?’ অবাক হয়ে জানতে চেয়েছে পিটার।
তারপর বাবা পাণ্ডুলিপি দেখে ছেলের প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন।
‘প্রভু অ্যানুবিস-এর হাতে আছে জীবন এবং মৃত্যুর চাবিকাঠি, তিনি গুপ্ত কার্নেটারকে পাহারা দেন, এবং কেউ তাঁর অনুমতি ছাড়া অবগুণ্ঠন উত্তোলন করতে পারে না। এই শেয়াল দেবতাকে যদি কেউ বন্ধু ভেবে থাকে তা হলে সে মহা ভুল করবে। কারণ তিনি বন্ধু নন। অ্যানুবিস ছায়ার দেবতা, আর এ জন্যেই তিনি সকল রহস্য গোপন রাখেন। বহু আগে, যে দিনের হিসেব কেউ জানে না, সেই সময় প্রভু অ্যানুবিস মানুষের সামনে প্রথমবারের মত উপস্থিত হয়েছিলেন। দেবতাদের মধ্যে তিনিই প্রথম এক বিশেষ চেহারায়, তাঁর প্রকৃত রূপে হাজির হন। তাঁর সেই বিশেষ চেহারা তুমি দেখতে পাবে ভেতরের বারান্দার শেষ মাথায়। দেখতে পাবে পথপ্রদর্শক-এর আসল চেহারা।’
‘সাংঘাতিক ব্যাপার তো!’ বিড়বিড় করে বলেছে পিটার। ‘ব্যাপারটা সত্যি হলে কী অবস্থা হবে চিন্তা কর একবার? শেয়াল দেবতার বিকট চেহারার আসল রূপ সামনাসামনি দেখার কথা ভাবা যায়!’
সার রোনাল্ড হেসেছেন শুধু, কোনও মন্তব্য করেননি। আবার পড়ায় মনোনিবেশ করেছেন তিনি।