তদন্ত শেষে পুলিশ তাদের রিপোর্টে লিখল মি. বদরুল হাসানের অস্বাভাবিক মৃত্যুর জন্য তিনি নিজেই দায়ী। একা থাকতেন তিনি, কারও সঙ্গে কথা বলতেন না। শেষ দিকে তাঁর মধ্যে এক ধরনের মস্তিষ্ক বিকৃতি লক্ষ করা যায়। ঘটনার দিন প্রচুর মদ খেয়ে বেরিয়ে পড়েন তিনি গাড়ি নিয়ে। (গাড়ির হুইলে তাঁর হাতের ছাপ এ প্রসঙ্গে লক্ষণীয়)। সম্ভবত তুরাগ নদীর ধারে এসে হাওয়া খেতে গাড়ি থেকে নেমে পড়েন। মাতাল অবস্থায় পাড় ভেঙে ছিটকে পড়েন নদীতে। এবং সলিল সমাধি লাভ করেন।
.
এই ঘটনার মাস ছয় পরে বনানী গোরস্তানে এসেছে তমিজ আলী কবরের গায়ে বেড়ে ওঠা ঘাস, আগাছা ইত্যাদি ছাঁটতে। ঘাস ছাঁটার যন্ত্র দিয়ে কাজটা এক মনে চালিয়ে যাচ্ছে সে। হঠাৎ একটা কবরের পাশে এসে যন্ত্রটা যেন পাগল হয়ে উঠল। বার বার তমিজ আলীর হাত থেকে ছিটকে যেতে চাইল, কবরটার গায়ে আঘাত করতে লাগল। যেন তীব্র ঘৃণা ভরে লাথি মারছে। তমিজ ভাবল তার যন্ত্রে বুঝি গোলমাল। সে ঘাস কাটার যন্ত্রটা পরীক্ষা করে দেখল। কোনও সমস্যা নেই। অন্য কবরের পাশের আগাছা ঠিকই সাফ করছে যন্ত্র, কিন্তু নতুন, দামী পাথরের এই কবরটার কাছে এলেই যেন খেপাটে আচরণ শুরু করে দিচ্ছে। কৌতূহল হলো তমিজ আলীর। কবরটার দিকে তাকাল সে ভাল করে। অল্প স্বল্প লেখাপড়া জানে। ক্লাস থ্রি পর্যন্ত পড়েছে। পড়ল
মি. বদরুল হাসান (১৯৫২-১৯৯৭)
এই কবরে নিশ্চয়ই জিনের আসর আছে, ভ্রূ কুঁচকে ভাবল তমিজ আলী। নইলে ঘাস কাটার যন্ত্র এমন করে কেন?
জিনের কথা ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিল ওর। এদিক ওদিক তাকাল। ধারে কাছে কেউ নেই। আয়াতুল কুরসী পড়ে বার তিনেক ফুঁ দিল বুকে। তারপর যন্ত্রটা শক্ত মুঠোয় চেপে কবরটার দিকে সভয়ে আরেক বার তাকিয়ে গোরস্তানের গেটের দিকে হন হন করে হাঁটা দিল।
ফাঁদ
অক্টোবরের এক সন্ধ্যায় ছোট্ট হোটেলটিতে এসে পৌছলেন মশিউ পিনেট। রাস্তার ওপর শরতের শুকনো পাতা, বিবর্ণ পথটা ধরে হেডলাইটের আলোয় গ্রামের আঁধার চিরে আসার সময় মনটা বেশ উৎফুল্লই ছিল পিনেটের। তিনি প্যারিস টেক্সটাইল ম্যানুফাকচারারের একটি বড় ফার্মের রিপ্রেজেন্টেটিভ। উত্তর ফ্রান্সের একঘেয়ে এলাকাগুলোতে আগে নিয়মিত ঢুঁ মেরেছেন পিনেট। দু’ধারে পপলার গাছের সারি, মাঝখানে রাস্তা। বহুবার তিনি এ রাস্তায় যাতায়াত করেছেন। আজ অবশ্য আলাদা আরেকটা এলাকায় এসেছেন তিনি, দক্ষিণের লিঁও থেকে ইলে ডি ফ্রান্সের দিকে যাত্রা শুরু করেছেন। তাঁর বেতন বেড়েছে, ফুর্তির এটি অন্যতম একটি কারণ। আর নতুন এলাকায় যেতে পারছেন, স্বভাবতই ভাল লাগছে তাঁর।
এ এলাকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এককথায় শ্বাসরুদ্ধকর। বিপুল বেগে গাড়ি ছুটিয়েছেন পিনেট, হাসিতে উদ্ভাসিত চেহারা। আনন্দ থাকারই কথা। অত্যন্ত সফল হয়েছে তাঁর এবারকার ট্যুর। মক্কেলের দেয়া টাকায় ফুলে আছে মানিব্যাগ।
এ মুহূর্তে তিনি ফ্রান্স থেকে পঞ্চাশ মাইল দক্ষিণে তাঁর বাড়ি কুরবোভোই’র শহরতলীতে। দীর্ঘ পথভ্রমণে শরীর বেজায় ক্লান্ত, গাড়ি ঠেলে বাড়ি পৌঁছার ধকল আর সইতে পারবেন না বুঝতে পেরেছেন। সেই অক্সেরে থেকে গাড়ি ছুটিয়ে আসছেন তিনি, এখন একটু বিশ্রাম না নিলেই নয়। একটা গ্রামের পাশ দিয়ে যাচ্ছেন, হঠাৎ ছোট হোটেলটার সাইনবোর্ডে আটকে গেল চোখ। সিদ্ধান্ত নিলেন রাতটা হোটেলে কাটিয়ে পরদিন বাড়ি ফিরবেন। হোটেলটা প্রায় একটা জঙ্গলের মধ্যেই বলা যায়। চারপাশে পাইন গাছ, একটা ক্যানভাসের নীচে কতগুলো চেয়ার-টেবিল ফেলে রাখা, অবশ্য হলওয়েতে আলো জ্বলছে। তার মানে এটা পরিত্যক্ত নয়। পাইন গাছের নীচে গাড়ি রাখলেন পিনেট। এক বার-এ চোখ পড়ল, অনেকগুলো বোতল সাজানো বারটিতে। দেখে মনে হয় উষ্ণ, তরল পদার্থে বোঝাই বোতলগুলো।
হোটেল বা সরাইখানাটির সামনে আর কোনও গাড়ি দেখা যাচ্ছে না। তবে ও নিয়ে পিনেটের ভাবনাও কিছু নেই। তিনি কারও সঙ্গ আশা করছেন না, এ মুহূর্তে আধ বোতল ওয়াইনের জন্য আকুলি-বিকুলি করছে বুকটা। মদ গিলে শরতের হিম ভাবটা থেকে রক্ষা পেতে চান। তারপর পেট পুরে ডিনার খেয়ে আট ঘণ্টা ঘুম দিলেই পরদিন সকালে তাজা মন ও শরীর নিয়ে যাত্রা শুরু করা যাবে প্যারিসের উদ্দেশে। গাড়ি পার্ক করে ওতে তালা লাগালেন পিনেট, তারপর হলঘরে ঢুকলেন। পালিশ করা মেঝেতে শুয়ে আছে একটা বেড়াল। শহুরে পোশাক পরা এক লোক কনিয়াক পান করছে। এ ছাড়া জীবনের চিহ্ন নেই কোথাও। লোকটা পিনেটকে দেখে মৃদু গলায় ‘শুভ সন্ধ্যা’ বলল। তারপর এক ঢোকে গ্লাসের তরল জিনিসটা শেষ করে বেরিয়ে গেল। মশিউ পিনেট জানালা দিয়ে দেখলেন একটা নীল রঙের বড় মার্সিডিজ নিয়ে চলে যাচ্ছে লোকটা। গাড়িটা রাস্তার ঢালে পার্ক করা ছিল।
কাউন্টারের বেল টিপে ধরতেই চটি ফটফট করে এগিয়ে এল এক লোক। বিনয়ের অবতার সেজে জানাল- হ্যাঁ, মশিউ অবশ্যই এখানে একটা ঘর পেতে পারেন, আর ডিনারের ব্যবস্থাও করা যাবে।
মশিউ পিনেট রেজিস্টারে নিজের নাম সই করলেন। চারপাশে চোখ বুলিয়ে অবাকই লাগল তাঁর, এতবড় ডাইনিং রুম, অন্তত দুশো মানুষ এক সাথে বসে খেতে পারে। অথচ কাউকে দেখা যাচ্ছে না। এটা ট্যুরিস্ট সিজন নয়, ব্যাখ্যা করল হোটেল মালিক। তাই লোকজন খুব কমই আসে। অবশ্য এ নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই পিনেটের। তিনি এখন ডিনার খেয়ে শুয়ে পড়তে পারলেই খুশি।