কিন্তু পায়ে সাপের দংশনের মত তীব্র জ্বালা টের পেতেই লাফিয়ে উঠলেন বদরুল। সেই রেজরটা। ধারাল খুরের আঘাতে গোড়ালির কাছ থেকে কেটে নিয়েছে প্যান্ট। গল গল ধারায় বেরুনো তাজা রক্ত সাথে সাথে শুষে নিয়ে আরও রক্তাক্ত রঙ ধারণ করল লালচে কার্পেট।
এক লাথিতে রেজরটাকে পা থেকে ফেলে দিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে গাড়ি-বারান্দার দিকে ছুটলেন বদরুল হাসান। অন্ধকারে ভূতের মত দাঁড়িয়ে ছিল শক্তিশালী, কালো মার্সিডিজ বেঞ্জটা। তিনি কাঁপা হাতে চাবি বের করলেন পকেট থেকে, তালা খুলতে গিয়ে ঝনাৎ করে পড়ে গেল রিংসুদ্ধ চাবি। নিজেকে বিশ্রী একটা গালি দিয়ে উবু হলেন বদরুল। হঠাৎ তাঁর পিলে চমকে দিয়ে মেঘ গর্জনের শব্দে চালু হয়ে গেল মার্সিডিজের ইঞ্জিন। সার্চ লাইটের মত একটা হেড লাইট জ্বলে উঠল অন্ধকারের বুক চিরে। তারপর ব্যাক গিয়ার মেরে গাড়িটা নিজেই পিছু হঠল। চাবি খুঁজবেন কী, এমন ভৌতিক কাণ্ড দেখে সব ভুলে হাঁ করে তাকিয়ে থাকলেন বদরুল হাসান গাড়ির দিকে। সম্বিত ফিরল যখন মার্সিডিজ সগর্জনে তাঁর দিকে ছুটে এল, তখন।
হেড লাইটের তীব্র আলো অন্ধ করে দিল বদরুল হাসানকে। গাড়িটা তাঁর গায়ের ওপর এসে পড়ছে বুঝতে পেরে ব্যাঙের মত লাফ দিলেন তিনি এক ধারে। আহত পা-টা বেকায়দায় পড়ল এক টুকরো দশ ইঞ্চি ইটের ওপর। দুনিয়া ফাটানো চিৎকার দিয়ে উঠলেন তিনি। পরক্ষণে চিৎকারটাকে গপ করে গিলে ফেলতে হলো মূর্তিমান আজরাইলকে আবার তাঁর দিকে ছুটে আসতে দেখে। ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে এবার দিক্বিদিক্ শূন্য হয়ে ছুটলেন মি. বদরুল হাসান।
মৃত্যু ভয় কাকে বলে টের পেলেন তিনি। ‘বাঁচাও! বাঁচাও!’ বলে চিৎকার করলেন কিন্তু কেউ শুনল না তাঁর কথা। তুরাগ নদীর ধারে, উত্তরার একেবারে শেষ প্রান্তে নিজের বাড়িটি করেছেন বদরুল সাহেব। এদিকে সকালে আর বিকেলে স্বাস্থ্যসেবীরা আসে তাজা বাতাস ভক্ষণ করতে। সন্ধ্যার পরে কেউ ভুলেও পথ মাড়ায় না। কারণ এখানকার বাসিন্দাদের সন্ধ্যার পর সময় কাটে ক্লাবে বা পার্টিতে। আর বদরুল সাহেবের মরণ আর্তনাদ কেউ শুনতে পাচ্ছে না কারণ তাঁর নিকটতম প্রতিবেশীর বাড়িও এখান থেকে অন্তত পাঁচশো গজ দূরে। সে বাড়িতে এ মুহূর্তে আলো জ্বলছে না। হয়তো বাসিন্দারা বেরিয়ে পড়েছে নৈশ অভিসারে। তাই কেউ দেখল না একটি অসহায় মানুষ উন্মত্ত যন্ত্র দানবের হাতে নির্মম মৃত্যুবরণ করতে চলেছেন।
খানাখন্দে হোঁচট খেয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে ছেলে বেলার কথা মনে পড়ছে বদরুল হাসানের। ছোট বেলা থেকেই সব ধরনের যান্ত্রিক অনুষঙ্গের প্রতি তাঁর বিতৃষ্ণা। বাড়ির টিভি, রেডিও ইত্যাদি নিজ হাতে খুলে, নব টব মুচড়ে দিয়ে বিকৃত মজা পেতেন তিনি। বড় হয়েও যায়নি বদভ্যাসটা। ইলেকট্রিক গ্যাজেটগুলো অনভ্যস্ত হাতে নাড়াচাড়ার কারণে বহুবার ওগুলো বিগড়ে গেছে আর সেই সাথে জিনিসগুলোর প্রতি ঘৃণা বেড়েছে বদরুল সাহেবের। মনে হয়েছে তাঁকে মানসিক অশান্তিতে রাখার জন্যই যন্ত্রগুলো ইচ্ছে করে নষ্ট হয়। আর তাঁকে মেরামতের জন্য বার বার পকেট থেকে মোটা অঙ্কের টাকা গচ্চা দিতে হয়।
কিন্তু এখন কৃতকর্মের জন্য বড্ড আফসোস হচ্ছে বদরুল হাসানের বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতিগুলোর ওপর এতকাল অবিচার করার ফল এখন পাচ্ছেন হাতে হাতে। জীবন দিয়ে মাশুল দিতে হচ্ছে।
বিশাল বপু নিয়ে গোঙাতে গোঙাতে ছুটছেন বদরুল হাসান। পেছনে অপ্রতিরোধ্য মৃত্যুর মত শখ করে কেনা মার্সিডিজ বেঞ্জ। আজ বিকেলেও ওটার দরজা ঠিক মত খুলছিল না বলে পেল্লায় এক লাথি বসিয়ে দিয়েছিলেন বদরুল। হয়তো সেই লাথির প্রতিশোধ নিতেই ছুটে আসছে মূর্তিমান আতঙ্ক।
ছুটতে ছুটতে তুরাগের পাড়ে এসে দাঁড়িয়ে পড়লেন বদরুল সাহেব। দূরে কোথাও পাড় ভাঙার অস্পষ্ট শব্দ বুকে কাঁপ ধরাল। নীচে তাকাতেই হিম হয়ে গেল শরীর। অন্ধকার। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। শুধু খলবলে জল রাশির শব্দ। পেছনে তাকালেন তিনি। হাত কয়েক দূরে দাঁড়িয়ে আছে যমদূত।
‘মাফ করো!’ দু’হাত জড় করে কেঁদে উঠলেন তিনি। ‘আমি সাঁতার জানি না। আমাকে এভাবে মেরো না, প্লীজ
জবাবে গর্জে উঠল ইঞ্জিন। আবার এগোতে শুরু করল মৃত্যু। এক পা করে পিছু হঠতে শুরু করলেন বদরুল হাসান। এগিয়ে আসছে মার্সিডিজ। একটা হেড লাইটে গাড়িটাকে এক চোখো দানবের মত লাগছে। চোখটা মৃত্যু খিদেয় অস্থির।
পিছু হঠতে হঠতে একেবারে পাড়ের কিনারে এসে গেলেন বদরুল হাসান। এখানে মাটি খুব নরম। তাঁর ভারী শরীরের ওজন সইতে পারল না নরম মাটি। হঠাৎই টের পেলেন বদরুল সাহেব পায়ের নীচ থেকে সরে যাচ্ছে আশ্রয়, পিছলে পড়ে যাচ্ছেন তিনি উঁচু পাড় থেকে। ছিটকে পড়ার আগ মুহূর্তে বদরুল সাহেবের মনে হলো মার্সিডিজের চোখটা যেন হাসছে। প্রতিশোধ নিতে পারার পরিতৃপ্তির হাসি!
চার
বদরুল হাসানের ফুলে ফেঁপে ওঠা পচা লাশ তুরাগের দক্ষিণে আবিষ্কার হলো দিন দুই পরে। মাছ ধরতে গিয়ে স্থানীয় জেলেরা লাশটাকে পেল। তাঁরা পুলিশের হাতে তুলে দিল মৃত দেহ।
যথারীতি পোস্টমর্টেম হলো। পোস্টমর্টেম রিপোর্টে ডাক্তার বললেন, প্রচুর মদ্য পানের আলামত পাওয়া গেছে তাঁর দেহে। রুটিন মাফিক তদন্তে পুলিশ বদরুল সাহেবের প্রতিবেশীদের কাছে জানতে পারল, বদরুল সাহেবকে নাকি অনেকেই দেখেছে একা, উদ্ভ্রান্তের মত কথা বলতে। দু’একজন প্রতিবেশী এটাও জানাল মাঝে মাঝেই তাঁর বাসার সামনে দিয়ে যাবার সময় গোঙানি আর চিৎকারের আওয়াজ শুনেছে। সমস্যা হয়েছে কিনা জানতে গিয়েছিল তারা। অপমানিত হয়ে ফিরে আসতে হয়েছে তাদেরকে। এরপর থেকে বদরুল হাসানের ব্যাপারে তারা আর মাথা ঘামায়নি।