মেডিসিনের জাঁদরেল ডাক্তার প্রফেসর বাতেনকে দেখাবেন, সিদ্ধান্ত নিলেন বদরুল সাহেব। কিন্তু ডা. বাতেনের সাথে আগে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করতে হয়। অভ্যাস বশে ফোর্নের দিকে হাত বাড়াতে গিয়েও নিজেকে সংযত করলেন। তাঁর সামনেই চিৎ হয়ে পড়ে আছে ভাঙা রিসিভার। এ এলাকায় কাছে পিঠে কার্ড ফোন সেন্টার নেই। এক কিলোমিটার দূরে পুলিশ বক্সের সাথে আছে একটা। এখন আর ওখানে যেতে ইচ্ছে করছে না। মোবাইল ফোনটাও অকেজো হয়ে পড়ে আছে। একবার ভোরের কাগজ-এ ফোন করার চেষ্টা করছিলেন জরুরী প্রয়োজনে। বার বার এনগেজড টোন পাওয়ায় মাথায় রক্ত চড়ে যায় বদরুল সাহেবের। সব দোষ মোবাইলের ওপর চাপিয়ে আছাড় দিয়ে ভেঙে ফেলেন তিনি ওটাকে। সন্ধ্যা বেলায় নিজেই যাবেন ডাক্তারের কাছে, সিদ্ধান্ত নিলেন বদরুল সাহেব। প্রফেসরের অ্যাসিস্ট্যান্টকে একখানা একশো টাকার নোট ধরিয়ে দিলে আজকেই সে অ্যাপয়েন্টমেন্টের ব্যবস্থা করে দেবে।
তিন
খিঁচানো মেজাজ নিয়ে বাসায় ফিরলেন বদরুল হাসান। প্রফেসর বাতেনকে পাননি তিনি। চেম্বার বন্ধ। শুক্রবার তাই। আরে, শুক্রবার বলে কি অসুখ- বিসুখগুলোও ছুটি নেয় নাকি? নাকি বন্ধের দিন বলে স্পেশাল তোয়াজ করে? যত্তসব কাণ্ডজ্ঞানহীন ডাক্তারের বাস এ দেশে।
রাগে গজ গজ করতে করতে বদরুল সাহেব বার ক্যাবিনেট থেকে একটা ‘ভ্যাট সিক্সটি নাইন’-এর বোতল বের করলেন। মদ্যপানের অভ্যাস তাঁর তেমন নেই। কোনও কারণে খুব উত্তেজিত হয়ে পড়লে তরল পদার্থটা টনিকের কাজ দেয়। কিন্তু আজ কাজ করল উল্টো। দপদপিয়ে ব্যথা শুরু হলো মাথায়। যেন ফেটে যাবে। ব্যালকনিতে এসে বসলেন। এক ফোঁটা বাতাস নেই। খিঁচানো মেজাজ খাট্টা হয়ে গেল আরও। ঢুকলেন শোবার ঘরে। ফুল স্পীডে এসি ছেড়ে দিলেন। ধুত্তুরি, ঘর ঠাণ্ডা হচ্ছে কই? নাকি এই ব্যাটাও জাত ভাইদের মত বিট্রে শুরু করে দিল? খানিকক্ষণ এয়ার কুলারের নবগুলো নিয়ে খোঁচাখুঁচি করলেন তিনি। মুখ প্রায় ঠেসে ধরলেন যন্ত্রটার গায়ে। উঁহুঁ, কেমন একটা গরম বাতাস আসছে না?’
‘আমার সাথে বিটলামি, না? দাঁড়া, দেখাচ্ছি মজা’ বলে বাথরুমে ঢুকলেন বদরুল হাসান। পানি দিয়ে চোবাবেন এয়ার কুলার। জবর শিক্ষা দিয়ে ছাড়বেন যাতে এমন ফাজলামি আর না করে।
বাথরুমের দরজায় পা রাখতেই বদরুলের চোখ কপালে উঠে গেল। শেভিং কেবিনেটে রাখা ইলেকট্রিক রেজরটা নিজে থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে। চোখ কচলালেন বদরুল। ভুল দেখছেন না তো? নাহ, ওই তো ওটা নড়ে উঠল। তারপরই বদরুল সাহেবকে লক্ষ্য করে লাফ দিল।
‘বাপরে।’ বলে মাথা সরিয়ে নিলেন বদরুল সাহেব। ভীষণভাবে মাথাটা ঠুকে গেল দরজার কোণে। কয়েক সেকেন্ডের জন্য বিনে পয়সায় তারার ফুলঝুরি দেখলেন তিনি। তারপর প্যান্ট বেয়ে সরসর করে কী একটা উঠে আসছে টের পেয়ে সেদিকে তাকাতেই আঁতকে উঠলেন। রেজরটা!
আহত জন্তুর মত গোঙানি বেরিয়ে এল বদরুল হাসানের গলা থেকে। হাতের এক ঝটকায় রেজরটাকে ফেলে দিয়ে দৌড়ালেন বেডরুমে। দরজা বন্ধ করার আগে এক পলক দেখলেন এঁকেবেঁকে এগিয়ে আসছে রেজর, ঠিক গোখরো সাপের মত ফণা তুলে।
দরজায় খিল দিয়ে কিছুক্ষণ হাপরের মত হাঁফালেন বদরুল। হঠাৎ টের পেলেন খুব শীত করছে তাঁর। চালু হয়ে গেছে এসি পুরো দমে। ঠকাঠক কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে গেল। এয়ার কুলার বন্ধ করার জন্য এগোলেন তিনি কিন্তু দু’পা এগোনোই সার। যন্ত্রটাতে যেন সাইক্লোন বইতে শুরু করেছে। শোঁ শোঁ শব্দ হচ্ছে বাতাসের। কিছুতেই এসির সামনে যাওয়া যাচ্ছে না। দেখতে দেখতে ঘরের তাপ মাত্রা অস্বাভাবিক ভাবে নেমে এল। বদরুল সাহেব বুঝলেন আর কয়েক মিনিট এ ঘরে থাকলে তিনি ঠাণ্ডায় জমেই মারা যাবেন। এয়ার কুলার বন্ধের আশা ত্যাগ করে দরজা খুললেন তিনি। এবং সাথে সাথে আক্রান্ত হলেন।
শয়তান রেজরটা যে দরজার কাছেই ওঁৎ পেতে ছিল, কে জানত? সোজা বদরুল সাহেবের টুটি লক্ষ্য করে ওটা লাফ দিল। একটুর জন্যে লক্ষ্য ভ্ৰষ্ট হলো আক্রমণ। সাঁৎ করে মাথা সরিয়ে নিয়েছেন বদরুল। রেজর গিয়ে ধাক্কা খেল দরজার চৌকাঠে
পড়িমরি করে দৌড় দিলেন বদরুল হাসান। এক সাথে তিনটে করে সিঁড়ি টপকাতে লাগলেন ওজনদার শরীর নিয়েও। নীচ তলায় নেমে পেছন ফিরে চাইতেই আতঙ্কে চোখ বড় বড় হয়ে গেল। রক্তের নেশায় উন্মাদ রেজরটা লাফাতে লাফাতে নেমে আসছে সিঁড়ি বেয়ে।
দৌড় দিতে গেলেন বদরুল হাসান। সকালে ছিঁড়ে রাখা টেলিফোনের তারে পা বেধে দড়াম করে খেলেন এক আছাড়। দুনিয়া দুলে উঠল চোখের সামনে। ঠিক তখন সবচেয়ে রোমহর্ষক ঘটনাগুলো ঘটতে শুরু করল।
স্টাডি রুমে আপনা থেকে জ্যান্ত হয়ে উঠল টাইপ রাইটার। খট খট শব্দে ওটা কী টাইপ শুরু করে দিয়েছে বদরুল সাহেব বুঝতে পারলেন খুব ভাল ভাবে। তাঁর বেডরুমের ভাঙা দেয়াল ঘড়িটা বাজতে শুরু করল ঢং ঢং শব্দে। ভাঙা টিভির শূন্য গহ্বর থেকে ভেসে এল খল খল হাসি। আর একই সঙ্গে ভাঙা ফোন বেজে উঠল। ‘ক্রিং ক্রিং’ শব্দটা বিস্ফোরণের মত বাজল কানে। বদরুল সাহেব শুনতে পেলেন দেয়াল ঘড়ি, টিভি আর ফোন এক সাথে বলতে শুরু করেছে, ‘তোমার আর রক্ষা নেই, বদরুল। আর রক্ষা নেই।
গোটা ব্যাপারটা অস্বীকার করতে মন চাইল বদরুল সাহেবের। চোখ বুজে ভাবার চেষ্টা করলেন তিনি যা শুনছেন সব মিথ্যা, যা দেখছেন তা দুঃস্বপ্ন বৈ অন্য কিছু নয়।