একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইলেকট্রিক রেজরটা হাতে নিলেন বদরুল হাসান। প্লাগ লাগানোই ছিল, সুইচ টিপতেই চালু হয়ে গেল যন্ত্র। গালে ছোঁয়ালেন তিনি ধারাল রেজার। আহ, কী ঠাণ্ডা! ইলেকট্রিক নিড়ানির মত দাড়ির জঙ্গল সাফ হতে লাগল মৃদু ঘস ঘস শব্দে। হঠাৎ উঃ! করে উঠলেন বদরুল সাহেব। ‘হাতটা সরিয়ে নিয়েছেন গাল থেকে। বিস্ফারিত চোখে আয়নার দিকে তাকিয়ে দেখলেন তাঁর কালচে চামড়ায় প্রথমে সাদা একটা কাটা দাগ ফুটে উঠল, সেকেন্ডের ভগ্নাংশের মধ্যে ফাঁকটা পূরণ হয়ে গেল টকটকে লাল রক্তে। অসাবধানতার জন্য মনে মনে নিজেকে তিরস্কার করলেন বদরুল সাহেব। গালে আবার রেজর ছোঁয়াতে যাবেন, আয়নায় তাকিয়ে দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল। রেজরটাকে অবিকল গোখরো সাপের ফণা মনে হলো, ছোবল মারতে উদ্যত। সরাসরি রেজরের দিকে চাইলেন বদরুল হাসান। হার্ট বিট মিস করল একটা। রেজরটা যেন ক্রূর চোখে তাকিয়ে আছে তাঁর দিকে। হঠাৎ রেজর ধরা হাতটা নড়তে শুরু করল। টেনে নিয়ে যাচ্ছে গালের দিকে। হাতটাকে থামাবার প্রাণপণ চেষ্টা করলেন বদরুল। পারলেন না। ছোবল দিল ওটা তাঁকে। তীব্র জ্বালা অনুভব করলেন জুলফির নীচে। ‘মাগো!’ বলে খালি হাত দিয়ে জায়গাটা চেপে ধরলেন, আঙুলের ফাঁক দিয়ে গড়াতে শুরু করল রক্ত। রক্ত পড়ছে গাল বেয়ে, হাতে ধরা ইলেকট্রিক রেজর, বদরুল হাসানের ভয়ার্ত মুখ—সব মিলে আয়নায় যেন সিনেমার এক ফ্রিজ শট।
একটা গাল দিয়ে রেজরটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন বদরুল। ওটা বাথরুমের দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে এক কোণে পড়ে থাকল। দ্রুত আয়োডিন লাগালেন তিনি কাটা জায়গায়। জ্বলে উঠল ভীষণ। দাঁতে দাঁত চেপে ড্রেসিং- এর কাজটা সারলেন বদরুল হাসান। তারপর রেজরটাকে চোখের আগুনে পোড়াবার ব্যর্থ চেষ্টা করে আবার তুলে রাখলেন যথাস্থানে। বাথরুম থেকে বেরিয়ে নাস্তা সারলেন বদরুল হাসান। তাঁর একটা ঠিকে ঝি আছে। ভোরবেলায় এসে বাসন-কোসন ধুয়ে, নাস্তা বানিয়ে, দুপুর আর রাতের খাবার রান্না করে চলে যায়।
নাস্তা সেরে সেদিনের ইত্তেফাকটা চোখের সামনে মেলে ধরলেন বদরুল সাহেব। সেই একই গৎবাঁধা খবর। দেশে মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি, টাকার আরেক দফা অবমূল্যায়ন, অমুক জায়গায় ডাকাতি, তমুক জায়গায় ছিনতাই ইত্যাদি ইত্যাদি। হেডিংগুলোয় চোখ বুলিয়ে বিরক্ত বদরুল কাগজটা ফেলে দিলেন টেবিল থেকে। টেনে নিলেন কফির কাপ। ধূমায়িত কফিতে চুমুক দিচ্ছেন, এই সময় বেজে উঠল ফোন। ঝন ঝন শব্দটা কানে মধু বর্ষণ করল। আসলে এই মুহূর্তে কারও সঙ্গ চাইছিলেন বদরুল সাহেব। হোক না সে অদৃশ্য সঙ্গী। সাগ্রহে রিসিভার কানে ঠেকালেন বদরুল হাসান।
‘ইটস বি হাসান স্পীকিং,’ গমগমে গলায় বললেন তিনি।
‘আচ্ছা, এটা কি তারকালোক?’ ভেসে এল একটা কচি কণ্ঠ।
‘না তো! তুমি কত নম্বর চাইছ?’
‘আমি একটু জাহিদ হাসানের নাম্বারটা চাইছি। ভীষণ দরকার। দিতে পারবেন?’
অপর প্রান্তে অনুনয়।
বেশ মজা পেলেন বদরুল হাসান। বোঝাই যাচ্ছে নয়-দশ বছরের বাচ্চা। তিনি বাচ্চাদের সাথে কথা বলতে বেশ পছন্দ করেন।
‘জাহিদ হাসানের নাম্বার দিয়ে কী করবে তুমি?’ কৌতুকের সুরে জানতে চাইলেন তিনি।
‘উনি না আমার খুব প্রিয় অভিনেতা। আপনি বিটিভিতে সবুজ সাথী দেখেন? ওই যে মফিজ পাগলা…’
শেষ কবে বিটিভি দেখেছেন মনে করতে পারলেন না বদরুল হাসান। স্যাটেলাইটের অনুষ্ঠানগুলোই তাঁর কাছে ট্র্যাশ মনে হয়, বিটিভি দূরে থাক। তবু বাচ্চাটার সাথে কথা চালিয়ে যাবার লোভে তিনি বললেন, ‘হুম। দেখেছি তো।
‘তা হলে তো কথাই নেই। জানেন, সেদিন না…’ সোৎসাহে কী যেন বলতে গিয়েছিল বাচ্চা, হঠাৎ লাইনটা কেটে গেল।
ভয়ংকর দৃষ্টিতে রিসিভারটার দিকে তাকিয়ে থাকলেন বদরুল হাসান। যেন লাইন কেটে যাবার জন্য ফোনটারই দোষ।
প্রচণ্ড জোরে তিনি রিসিভারটা ক্রেডলে নামিয়ে রাখলেন। গায়ের ঝাল কমল যেন কিছুটা। তারপরও ওটার দিকে কটমট করে চেয়ে রইলেন। এমন সময় আবার ‘ক্রিং ক্রিং’ আওয়াজ। বাচ্চাটাই আবার ফোন করেছে ভেবে তাড়াতাড়ি রিসিভার কানে ঠেকালেন বদরুল হাসান।
‘এখনও সময় আছে, বদরুল। ভেগে পড়ছ না কেন?’ ভরাট গলায় কেউ বলে উঠল ওধার থেকে।
‘কী!’ প্রায় চিৎকার করে উঠলেন বদরুল হাসান।
‘বলছি এখনও সময় আছে, বদরুল। ভেগে পড়ছ না কেন?’ কথাটা পুনরাবৃত্তি করল অদৃশ্য কণ্ঠ।
আর সহ্য করতে পারলেন না বদরুল হাসান। ‘ইউ ব্লাডি ফুল!’ বলে গায়ের জোরে রিসিভারটা ছুঁড়ে মারলেন। তারে টান খেয়ে ক্রেডলসুদ্ধ হুড়মুড়িয়ে পড়ে গেল ফোন। টপ সেন্টার টেবিলের এক কোণে ফোনের তার বেধে গেল যেন কীভাবে। শূন্যে ঝুলতে লাগল রিসিভার। মাউথ পিস দিয়ে একভাবে, একঘেয়ে কথাগুলো ভেসে আসতে লাগল বার বার-’এখনও সময় আছে, বদরুল। ভেগে পড়ছ না কেন?’
ছুটে গেলেন বদরুল। এক টানে ছিঁড়ে ফেললেন তার। তারপর পাগলের মত রিসিভারটা কার্পেটে ঢাকা মার্বেল পাথরের মেঝেতে ঠুকতে লাগলেন। ভেঙে টুকরো হয়ে গেল ওটা কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে। ভাঙা ফোনের পাশে বসে হাঁফাতে লাগলেন তিনি।
কিছুক্ষণ পর সুস্থির হয়ে ভাবতে বসলেন বদরুল হাসান। এরকম কেন ঘটছে? তাঁর মাথা টাথা সত্যি খারাপ হয়ে যায়নি তো? তিনি কি স্রেফ হ্যালুসিনেশনের শিকার নাকি যা ঘটছে সব বাস্তব? শেহনাজ ঠিকই বলেছে তাঁর আসলে ডাক্তার দেখানো দরকার। নাকি সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাবেন? ধুর তিনি কি পাগল নাকি যে পাগলের ডাক্তারের কাছে যাবেন? তারচে’ কোনও মেডিসিনের ডাক্তারের কাছে যাওয়াই ভাল। ঘুম না হওয়াটাই তাঁর রোগ। কীভাবে ঘুম হবে এটা জানতে হলেও একবার ডাক্তারের কাছে যাওয়া দরকার।