‘এখান থেকে ভাগো, বদরুল,’ গলার স্বর সপ্তমে তুলে বললেন তিনি। ‘গোল্লায় যা তুই। আমাকে বেরিয়ে যেতে বলার কে তুই?’ জোর করে চোখ বন্ধ করে রাখলেন বদরুল সাহেব, ঘামে ভেজা মুখে হাত ছোঁয়ালেন। ‘এটা একটা যন্ত্র…একটা টাইপ রাইটার। ফালতু একটা জিনিস…’
স্থির হয়ে গেলেন তিনি লিভিং রুমের টিভি থেকে ভেসে আসা একটা কণ্ঠ শুনে।
‘এখান থেকে ভাগো, বদরুল।’ বলছে কণ্ঠটা।
বুকের ভেতর ব্যাঙের মত লাফাতে শুরু করল হৃৎপিণ্ড, ঘুরেই ছুটলেন বদরুল লিভিং রুমের দিকে। হাতে গিটার নিয়ে অল্প বয়েসী একটা মেয়ে নাচছে টিভি পর্দায়। নাচের সময় হাইহিলে শব্দ তুলছে, সোজা তাকাচ্ছে বদরুল সাহেবের দিকে। মিউজিকের তালে মেয়েটা নাচতেই থাকল। তা হলে গলার স্বরটা নিশ্চয়ই ভুল শুনেছেন, ভাবলেন বদরুল হাসান। সেক্রেটারী মেয়েটা ঠিকই বলেছে। নিদ্রাহীনতার কারণে আবোল তাবোল দেখছেন আর শুনছেন তিনি।
টিভির মিউজিক থেমে গেল। মেয়েটি গিটার হাতে ক্যামেরার সামনে ‘বো’ করল, মুখ তুলে আবার সরাসরি তাকাল বদরুল সাহেবের চোখের দিকে।
মিষ্টি করে হাসল মেয়েটা, স্পষ্ট উচ্চারণে বলল, ‘এখান থেকে ভাগো, বদরুল।
রাগের চোটে বিকট চিৎকার করে উঠলেন বদরুল হাসান। হাতের কাছে ফ্লাওয়ার ভাসটা নিয়ে গায়ের শক্তিতে ছুঁড়ে মারলেন টিভিটার দিকে। প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরিত হলো টিভি, গ্লাস ভেঙে শত টুকরো হলো, ধোঁয়া উঠতে লাগল গল গল করে। তারপরও, কী ভয়ানক ব্যাপার, ধোঁয়ার মাঝ থেকে মেয়েটার রিনরিনে কণ্ঠ ভেসে আসতে লাগল।
‘এখান থেকে ভাগো, বদরুল,’ বলে চলল কণ্ঠটি। আহত জন্তুর মত চিৎকার দিয়ে ঘর ছেড়ে বেরোলেন বদরুল, হলঘর পেরিয়ে উঠে গেলেন সিঁড়িতে।
টপ ল্যান্ডিং-এ দাঁড়িয়ে নীচের দিকে তাকালেন তিনি, গলার রগ ফুলে গেল চিৎকার করার সময়। ঠিক আছে। ঠিক আছে নির্বোধ যন্ত্রের দল। তোরা আমাকে ভয় দেখাতে পারবি না। শুনতে পাচ্ছিস? আমি জীবনেও তোদেরকে ভয় পাব না।’
ঠিক তখন পড়ার ঘর থেকে গভীর, স্পষ্ট এবং ছন্দায়িত ভঙ্গিতে ভেসে এল টাইপ রাইটারের শব্দ। বদরুল বুঝতে পারলেন হারামজাদাটা কী টাইপ করছে। ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করল তাঁর। তবে নিজেকে সামলে নিয়ে ঢুকলেন বেড রুমে, দরজা বন্ধ করলেন। তারপর বালিশে মুখ চেপে শুয়ে পড়লেন বিছানায়। বন্ধ দরজা ভেদ করেও টাইপ রাইটারের টাইপ করার শব্দ ভেসে আসতে লাগল। তারপর এক সময় আপনাআপনি থেমে গেল। নীরব হয়ে গেল বাড়ি।
দুই
সে রাতেও যথারীতি ঘুম হলো না বদরুল হাসান সাহেবের। একাধিকবার দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠলেন তিনি। সারা শরীর ঘেমে চুপচুপে। ঘুমের আশা বাদ দিয়ে সিলিং-এর হালকা নীলাভ আলোর দিকে চেয়ে থাকলেন চুপচাপ। হঠাৎ ঢং ঢং শব্দে বাজতে শুরু করল দামী সুইস দেয়াল ঘড়িটা। গুণতে থাকলেন বদরুল হাসান। বারো…এক…দুই…তিন। থেমে গেল ঘণ্টাধ্বনি। তাঁকে আতঙ্কিত করে দিয়ে ভেসে এল ধাতব, খনখনে কতগুলো শব্দ, ‘এখনও সময় আছে। ভেগে পড়ো, বদরুল।’ চোখ বড় বড় করে ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকলেন বদরুল সাহেব। ওখান থেকেই কথাগুলো আসছে। ভাঙা রেকর্ডের মত একভাবে বেজে যেতে লাগল পেণ্ডুলাম। আর সহ্য হলো না বদরুল সাহেবের। বেড সাইড টেবিলের ওপর মার্বেল পাথরের সাদা একটা কুকুরের মূর্তি ছিল, ওটাকে ঝট করে হাতে তুলে নিলেন তিনি। ‘শুয়োরের বাচ্চা।’ বলে ছুঁড়লেন দেয়াল ঘড়ি লক্ষ্য করে। কাঁচ ভাঙার তীক্ষ্ণ শব্দ হলো। ফেটে চৌচির হয়ে গেল শৌখিন জিনিসটা। কিন্তু পেণ্ডুলামটা দুলতেই থাকল আগের মত। আর সেই অসহ্য কথাগুলো! উঃ!
কানে আঙুল চাপা দিয়ে ছিটকে ঘর থেকে বেরুলেন বদরুল হাসান। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেন। ঘড়ির শব্দ বন্ধ হয়ে গেছে। তবু ভেতরে যেতে সাহস পেলেন না তিনি। ঝুল বারান্দায় ইজি চেয়ারটায় বসে থাকলেন চুপচাপ। অন্ধকার আকাশে তাঁর দৃষ্টি। দরদর ধারায় জল পড়ছে চোখ বেয়ে। অঝোরে কাঁদছেন বদরুল হাসান।
.
ভোরের নরম রোদ গায়ে মেখে জেগে উঠলেন বদরুল হাসান। কাঁদতে কাঁদতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছেন মনে নেই। ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ সামনের রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। কয়েকজন কৌতূহলী মর্নিং ওয়াকার পথ চলতে তাঁর দিকে ফিরে তাকাচ্ছে। ব্রিত বোধ করলেন বদরুল সাহেব। প্রতিবেশীদের সাথে তাঁর সদ্ভাব নেই। তাঁর কাছে প্রতিবেশী মানেই পরনিন্দা, পরচর্চাকারী। এজন্য কোনও দিন কারও সাথে সেধে আলাপ করার প্রবৃত্তি হয়নি বদরুল সাহেবের। আর তারাই তাঁকে সাত সকালে ব্যালকনিতে হাঁ করে ঘুমাতে দেখে নিশ্চয়ই মুখরোচক গল্পের সন্ধান পেয়ে গেছে। অবশ্য কে কী বলল তার থোড়াই কেয়ার করেন তিনি। লোকগুলোর দিকে মুখ বাঁকিয়ে তিনি ঢুকে গেলেন ঘরে। তারপর ফ্রেশ হতে বাথরুমে ঢুকলেন।
প্রতিদিন শেভ করার অভ্যাস বদরুল সাহেবের। কিন্তু আজ ক’দিন গালে ব্লেড ছোঁয়াননি ইচ্ছে করেই। ঘুম হয় না বলে অবসাদ তাঁকে গ্রাস করে থাকে সর্বক্ষণ। আয়নায় তাকিয়ে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে চমকে উঠলেন বদরুল হাসান। একী দশা! চোখের নীচে কয়েক পোচ কালি, খোঁচা খোঁচা দাড়িগুলো সব সাদা। গালের হনু দুটো জেগে উঠেছে প্রকটভাবে। চোখের সাদাটে জমির পাশে ছানির মত কী যেন। চাউনিটা উদ্ভ্রান্ত, অসহায়।