হাত দিয়ে মুখ ঢাকলেন বদরুল হাসান। আঙুলের ফাঁক দিয়ে তাকালেন শেহনাজের দিকে। ভীত, সন্ত্রস্ত দৃষ্টি।
‘আমি খুব ক্লান্ত,’ ভাঙা গলায় বললেন তিনি। ‘গত চার রাত এক ফোঁটাও ঘুমাতে পারিনি। আর এখন একা থাকার কথা ভাবলেই…’ ব্যক্তিগত দুর্বলতা প্রকাশ করে ফেলছেন অনিচ্ছাসত্ত্বেও, ভাবনাটা নিজের ওপর বিরক্তি এনে দিল তাঁর। তবু বলে চললেন, ‘এ সত্যি অসহ্য, শেহনাজ। অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটেছে আমার চারপাশে। ব্যাখ্যাতীত ঘটনাগুলো।
‘বলে যান।
টিভি সেটের দিকে আঙুল তুললেন বদরুল সাহেব, ‘ওই…ওই যে জিনিসটা ওখানে। ওটা গভীর রাতে আপনা আপনি চালু হয়ে যায়, জাগিয়ে রাখে আমাকে সারারাত।’ তাঁর চোখ ঘর ঘুরে স্থির হলো হল রুমের দিকে ‘আর ওই পোর্টেবল রেডিওটা দেখ। ওটাকেও আমি বেডরুমে রাখি। ঘুমাতে গেলেই রেডিওটা নিজ থেকে অফ-অন হতে থাকে।’
কথা বলতে বলতে মাথা নিচু করে ফেলেছিলেন বদরুল সাহেব, যখন মুখ তুললেন, শেহনাজ লক্ষ করল চোখের তারায় অদ্ভুত একটা পাগলামির ভাব ফুটে উঠেছে। ‘আমার বিরুদ্ধে এই বাড়িতে ষড়যন্ত্র চলছে; শেহনাজ। টিভি সেট, রেডিও, লাইটার, ইলেকট্রিক ঘড়ি, আর…আর ওই বদমাশ গাড়িটাও যেটাকে আমি চালাই।’
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন বদরুল হাসান, মুখ সাদা হয়ে গেছে, উত্তেজিত। ‘গত রাতে গাড়িটা আমি গ্যারেজে ঢোকাচ্ছিলাম খুব ধীরে আর সাবধানে।’ শেহনাজের দিকে এক পা এগিয়ে এলেন তিনি, হাতের মুঠো বার বার খুলছেন আর বন্ধ করছেন। হঠাৎ হুইলটা আমার হাতের মধ্যে ঘুরতে শুরু করল। শুনলে? আপনা থেকেই হুইলটা ঘুরছিল। স্রেফ সেধে গিয়ে ধাক্কা খেল গ্যারেজের এক ধারে। ভাঙল একটা হেড লাইট-ওই যে ম্যান্টেলপিসের ওপর।’
শেহনাজ ম্যান্টেলপিসের দিকে তাকাল। ওখানে কিছু নেই। প্রশ্নবোধক দৃষ্টি শেহনাজের।
‘আমি…আমি ওটা ফেলে দিয়েছি,’ ভীরু গলায় বললেন বদরুল হাসান। তারপর জোর করে গলায় স্বর ফোটালেন, ‘এরকম অবস্থা অনেক আগে থেকে হয়ে আসছে, শেহনাজ, কোনওদিনই আমি যন্ত্রপাতি ঠিক মত ব্যবহার করতে পারিনি।’ হাহাকারের মত শেষ বাক্যটা যেন বেরিয়ে এল বদরুল সাহেবের গলা চিরে।
শেহনাজ স্থির চোখে তাকাল তাঁর দিকে, মায়া হলো আত্মম্ভরী লোকটার জন্য।
‘হাসান সাহেব,’ খুব নরম গলায় বলল সে, ‘আমার মনে হয় আপনার ডাক্তার দেখানো উচিত।’
বদরুল হাসানের চোখ জোড়া বিস্ফারিত হয়ে উঠল, কর্কশ শোনাল কণ্ঠ। ‘ডাক্তার!’ চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি। ‘বিংশ শতাব্দীর সর্বরোগ হরণকারী বলে দাবী করা ইডিয়েটগুলো! যদি বিষণ্নতায় ভোগো ডাক্তার দেখাও। যদি সুখে থাকো তা হলেও ডাক্তার এনে এর কারণ খোঁজো। আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হলেও ডাক্তারের কাছে যাও। তুমি,’ গলা ফাটালেন তিনি শেহনাজকে লক্ষ করে, ‘নিজে গিয়ে ডাক্তার দেখাও না।’ রাগে কাঁপছে গলা। ‘আমি একজন যুক্তিবাদী, র্যাশনাল, বুদ্ধিমান মানুষ। আমি জানি আমি কী দেখছি। আমি জানি কী শুনছি। গত তিন মাস ধরে যান্ত্রিক ফ্রাঙ্কেনস্টাইনগুলো আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে, আমাকে শেষ করার পাঁয়তারা কষছে। বুঝলে, মিস শেহনাজ পারভীন?’
শেহনাজ কয়েক সেকেন্ড উত্তেজিত লোকটাকে যেন জরীপ করল। তারপর বলল, ‘বুঝলাম, সার। আপনি সত্যি খুব অসুস্থ। আসলেই আপনার চিকিৎসার দরকার। রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে আপনার নার্ভের বোধ হয় ক্ষতি হয়েছে। তাই আবোল তাবোল সব দেখছেন এবং শুনছেন।’
মেঝের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবল শেহনাজ, তারপর ঘর থেকে বেরুবার জন্য পা বাড়াল।
‘যাচ্ছ কোথায় তুমি?’ চেঁচিয়ে উঠলেন বদরুল।
‘আপনার কারও সঙ্গ প্রয়োজন নেই, সার।’ বলল শেহনাজ হলঘর থেকে। ‘আপনার দরকার ডাক্তার দেখানো।’
‘দেন গেট আউট অভ হিয়ার,’ আবারও উত্তেজিত হয়ে উঠলেন তিনি। ‘এক্ষুণি বেরিয়ে যাও। আর কোনও দিন যেন তোমার মুখ না দেখি।’
‘জীবনেও দেখবেন না,’ বলল শেহনাজ। ‘আপনার মত পাগলের সাথে কাজ করে কোন্ বোকা?’ দুপদাপ পা ফেলে সে দরজার দিকে এগোল।
‘সাবধান,’ চেঁচিয়ে বললেন বদরুল হাসান। ‘আর কোনওদিন যেন তোমাকে এখানে না দেখি। তোমার চেক আমি পাঠিয়ে দেব। আর শুনে রাখো, তোমার মত বেয়াদব সেক্রেটারীর কখনও প্রয়োজনও হবে না আমার।’
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল শেহনাজ। বুক ভরে বাতাস নিল, তারপর আশ্চর্য শান্ত গলায় বলল, ‘মি. বদরুল হাসান, যন্ত্র নিয়ে যে যন্ত্রণায় আপনি আছেন, প্রার্থনা করি, তা থেকে খুব সহজে যেন নিষ্কৃতি না পান।
বেরিয়ে গেল শেহনাজ, পেছনে দড়াম করে বন্ধ হলো দরজা। মূর্তির মত নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকলেন বদরুল হাসান। উপযুক্ত শব্দ হাতড়াচ্ছিলেন সেক্রেটারীকে বাক্যবাণে বিদ্ধ করতে। কিন্তু শেহনাজ চলে গেছে বুঝতে পেরে উৎসাহ হারিয়ে ফেললেন। এমন সময় শুনলেন ইলেকট্রিক টাইপ রাইটারটা খট খট শব্দ করছে।
বুকের রক্ত জল হয়ে গেল তাঁর শব্দ শুনে। কিছুক্ষণ পরে থেমে গেল টাইপ রাইটার। পড়ার ঘরে ঢুকলেন বদরুল হাসান। টাইপ রাইটারে কাগজ পরানো। বদরুল সাহেব রোলারটা ঘোরালেন কাগজের লেখা পড়ার জন্য। তিন লাইনে লেখা একই কথা, ‘এখান থেকে ভাগো, বদরুল।’
নিজেই এই কথাগুলো লিখেছে টাইপ রাইটারটা। টুকরোটা ছিঁড়ে আনলেন তিনি যন্ত্র থেকে, দলা মোচড়া করে ফেলে দিলেন মেঝের ওপর।