এ মুহূর্তে মি. বদরুল হাসান তাঁর বিশাল বেডরুমের দরজা খুলে নেমে আসছেন সিঁড়ি বেয়ে। পরনে স্মোকিং জ্যাকেট, এগোলেন খুদে স্টাডি রুমের দিকে। ওখান থেকে টাইপ রাইটারের খটাখট শব্দ ভেসে আসছে। তাঁর সেক্রেটারী, শেহনাজ পারভীন বদরুল সাহেবের নোটগুলো টাইপ করছে। বদরুল হাসান এগুলো বিভিন্ন পত্রিকায় পাঠাবেন। তিনিও টাইপ জানেন তবে টাইপ রাইটার মেশিনটিকে আরও অনেক যন্ত্রের মতই পছন্দ করেন না। কম্পিউটারের প্রতি তাঁর বিতৃষ্ণা আরও বেশি। এ কারণে জিনিসটি কেনেননি তিনি।
শেহনাজ পারভীনের বয়স তেইশ। সে সুন্দরী এবং আকর্ষণীয়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লাইব্রেরী সায়েন্সে এম. এ করছে। মি. বদরুল হাসানের কাছে পার্ট টাইমের কাজ করে। যা বেতন পায় তা দিয়ে হোস্টেল খরচা তো চলে যায়ই, দেশের বাড়িতে ছোট ভাইটাকেও মাসে মাসে পাঠাতে পারে কিছু।
শেহনাজ পারভীন বদরুল হাসানের তেরো নম্বর সেক্রেটারী। শোনা যায়, কোনও মেয়েই নাকি বদরুল সাহেবের সাথে এক মাসের বেশি কাজ করতে পারেনি তাঁর তিরিক্ষি মেজাজের · কারণে। শেহনাজের ধৈর্য প্রশংসনীয়। মাস তিন হলো সে সেক্রেটারীর কাজটি করে যাচ্ছে কোনও ত্রুটি-বিচ্যুতি ছাড়াই।
টাইপ করতে করতে মাথা তুলে চাইল শেহনাজ। তাঁর বস ভেতরে ঢুকেছেন। হোল্ডারসহ সিগারেট ঝুলছে মুখ থেকে। উদাসীন ভঙ্গিতে তিনি একবার পেছনে ফিরে দেখলেন, তারপর শেহনাজের পেছনে এসে দাঁড়ালেন। উঁকি দিলেন টাইপ রাইটারে আটকানো কাগজটার দিকে। তারপর ডেস্ক থেকে কতগুলো কাগজ হাতে নিলেন।
‘সারা বিকেল বসে তুমি এই করেছ?’ জানতে চাইলেন তিনি ঠাণ্ডা গলায়।
চোখে চোখ রাখল শেহনাজ। স্পষ্ট গলায় বলল, ‘জ্বী। সাড়ে তিন ঘণ্টায় চল্লিশ পৃষ্ঠা টাইপ করেছি, সার। আমার সাধ্যে এই কুলাল।’
টাইপ রাইটারের দিকে আঙুল নাচালেন বদরুল হাসান। ‘ইডিয়েট গ্যাজেটটা দিয়ে মাত্র চল্লিশ পৃষ্ঠা টাইপ! আরে, টমাস জেফারসন মাত্র আধাদিনে পালকের কলম দিয়ে আমেরিকার সংবিধান লিখেছিলেন, তা জানো?’
রিভলভিং চেয়ারটা ঘোরাল শেহনাজ। শীতল শোনাল কণ্ঠ, ‘তা হলে মি. জেফারসনকে ভাড়া করছেন না কেন, সার?’
বদরুল হাসানের বাম ভ্রু লাফিয়ে উঠল। ‘তোমাকে আমি বলিনি যে মুখে মুখে তর্ক একদম পছন্দ নয় আমার?’
টাইপ রাইটারের ওপর ঝুঁকে পড়ে বলল, শেহনাজ, ‘অসংখ্যবার এবং অসংখ্যবার বলেছেন।’ আবার সোজা হয়ে বসল। ‘একটা কথা বলব, সার।’ ভ্যানিটি ব্যাগের দিকে হাত বাড়াল। ‘আরেকটা নতুন মেয়ের খোঁজ করুন, এমন কেউ যার তিনটে হাত এবং গায়ে গণ্ডারের চামড়া তা হলে তার সঙ্গে নির্বিঘ্নে কাজ করতে পারবেন। আমার পক্ষে…’ সশব্দে নিজের পকেট বুক বন্ধ করল শেহনাজ। আপনার সাথে কাজ করা সম্ভব নয়।
‘চাকরিটা ছেড়ে দিতে চাইছ?’ জিজ্ঞেস করলেন বদরুল সাহেব।
‘জ্বী। ছাড়তাম আরও আগেই। কারণ আপনার মত এত খুঁতখুঁতে, খামখেয়ালী স্বভাবের লোকের সঙ্গে কাজ করার মত ঝক্কি আর নেই। একটা স্কলারশিপ পেয়েছি আমি। আগামী মাসে ইউরোপে চলে যাচ্ছি।’ ব্যাগটা ঝুলিয়ে বেরিয়ে গেল শেহনাজ।
বিমূঢ় দেখাল বদরুল হাসানকে, কিছু বলার জন্য মুখ খুললেন একবার, জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজালেন, তারপর স্বভাব বিরুদ্ধ অত্যন্ত নরম গলায় ডাক দিলেন পেছন থেকে। ‘শেহনাজ…দয়া করে যেয়ো না।
থমকে দাঁড়াল শেহনাজ পারভীন। ঘুরল। বদরুল সাহেবের চেহারায় ভয়ার্ত একটা ছাপ ফুটে উঠেছে যা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস হত না ওর।
‘কিছু বললেন?’ কোমল স্বরে বলল শেহনাজ।
মুখ ঘোরালেন বদরুল হাসান, অস্বস্তিতে ভুগছেন যেন। ইয়ে মানে…আরেকটু সময় যদি আমার সাথে থাকতে। না, কোনও কাজের জন্য নয়। ইয়ে…আজ এক সাথে ডিনারটা না হয় করলাম…’ আশা নিয়ে চেয়ে থাকলেন তিনি শেহনাজের দিকে।
‘আমার খিদে পায়নি তেমন,’ এক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল শেহনাজ। ‘তা ছাড়া ডিনারের সময় এখনও হয়নি। হতাশা ফুটে উঠতে দেখল সে বস-এর মুখে। ‘হয়েছে কী আপনার, সার?’ সহানুভূতির সুর নেই, এমনি প্রশ্ন।
হাসতে চেষ্টা করলেন বদরুল হাসান। কেমন বিকৃত দেখাল মুখ। ‘না, হবে আবার কী? তাড়া না থাকলে চলো ঘুরে আসি কোথাও থেকে।’
ঝাড়া দু’মিনিট বদরুল হাসান সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল শেহনাজ। তারপর থমথমে গলায় বলল, ‘ধন্যবাদ সার। আজ আমার সত্যি তাড়া আছে আর তাড়া না থাকলেও আপনার সঙ্গে কোথাও যেতাম না আমি। কেন, সে ব্যাখ্যা নিশ্চয়ই আপনাকে দিতে বাধ্য নই আমি। গুড নাইট, মি. বদরুল হাসান।’
বদরুল হাসান সাহেবের মুখের রঙ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। একটু টলে উঠলেন তিনি। লোকটার আবার প্রেশার উঠে যাচ্ছে না তো? শঙ্কিত হয়ে ভাবল শেহনাজ। সে কিছু বলার আগেই বদরুল হাসান বলে উঠলেন, ঠিক আছে, শেহনাজ। ঠিক আছে। কোথাও যেতে হবে না। এক কাপ কফি খেতে খেতে একটু গল্প করার সময়ও কি হবে না তোমার? আমার আসলে এই মুহূর্তে একা থাকার কথা ভাবলে খারাপ লাগছে।’
আবার লিভিং রুমে ফিরে এল শেহনাজ, দাঁড়াল বদরুল হাসানের পাশে। ‘আপনি অসুস্থ নাকি, সার?’ জিজ্ঞেস করল সে।
এদিক ওদিক মাথা নাড়লেন বদরুল সাহেব।
‘তা হলে কোনও দুঃসংবাদ?’
‘না।’
এক মুহূর্ত নীরবতা। আবার জানতে চাইল শেহনাজ।
‘তা হলে সমস্যাটা কী আপনার?’