চেহারা থমথমে হয়ে গেল মি. বদরুল হাসানের, নীচের পাতলা ঠোঁট দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরলেন তিনি।
‘হারামজাদা টিভিটার পেছনে রিপেয়ারের জন্য এ পর্যন্ত যত টাকা আমি ঢেলেছি,’ বললেন তিনি, তাতে নতুন আরেকটা সেট কেনা যেত।’
হাসল আবদুস সামাদ। নরম গলায় বলল, ‘তা হয়তো যেত। কিন্তু সার. গতবার আপনি আমার সামনেই এমন লাথি মারলেন স্ক্রিনে যে….’
ঘুরে দাঁড়ালেন বদরুল হাসান, হোল্ডারে একটা সিগারেট ঢোকালেন। ‘মনে আছে আমার,’ তাঁর কণ্ঠ তেতো শোনাল। ‘কিন্তু ফাজিলটা ঠিক মত কাজ করছিল না।’ শ্রাগ করলেন তিনি। ‘ভেবেছিলাম লাথি গুঁতা খেয়ে যদি ঠিক হয়।’
‘কিন্তু লাথি খেয়ে ওটার আবার বারোটা বেজেছে,’ এদিক ওদিক মাথা নাড়ল আবদুস সামাদ হতাশ ভঙ্গিতে। ‘এভাবে করলে তো, সার, একটা জিনিসও টিকিয়ে রাখতে পারবেন না।’
‘আমাকে উপদেশ দিতে এসো না, আবদুস সামাদ,’ গমগমে গলায় বললেন বদরুল হাসান। টিভির সমস্যাটি কী সেটা বলো।
টুল বক্স বন্ধ করল আবদুস সামাদ। উঠে দাঁড়াল। উপদেশ দিচ্ছি না, সার। একটু সাবধানে জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করতে বলছিলাম। ইলেকট্রনিক্স জিনিসের মা-বাপ নেই, সার। গ্যারান্টিও কম। আপনার টিভিতে এবার বেশ বড় রকমের সমস্যা হয়েছে। তারটার সব ছিঁড়ে গেছে। আরও কী ক্ষতি হয়েছে খোদা মালুম। গত মাসে আপনার রেডিওর একই রকম অবস্থা হয়েছিল। আপনি ওটাকেও ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন।’
‘রেডিওটাও ঠিকমত কাজ করছিল না,’ বদরুল সাহেবের কণ্ঠ বরফশীতল।
‘কিন্তু কেন কাজ করছিল না, সার? বেয়াদবী মাফ করবেন-আমার ধারণা আপনি রেডিও-টিভি কোনটারই ঠিকমত যত্ন নেন না।’
ঠোঁটে ঝোলানো হোল্ডারের সিগারেটে ধীরে সুস্থে আগুন জ্বালালেন মি. বদরুল হাসান। এক মুখ ধোঁয়া ছাড়লেন, তারপর বিজ্ঞানী যেভাবে মাইক্রোস্কোপে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কীট দেখেন, ঠিক সেরকম দৃষ্টিতে তাকালেন আবদুস সামাদের দিকে।
‘এই ব্যাখ্যার জন্য তোমাকে নিশ্চয়ই আমাকে আলাদা চার্জ দিতে হবে না?’
এদিক ওদিক মাথা নাড়ল রিপেয়ারম্যান। ‘আসল ব্যাপারটা কী বলুন তো, সার? বার বার এরকম হচ্ছে কেন?’
‘জানি না,’ কর্কশ গলায় বললেন হাসান সাহেব। ‘বললামই তো টিভিটা ঠিকমত কাজ করছিল না। আর তোমার এত ভ্যাজর ভ্যাজর করার কী দরকার? সেট ঠিক হয়েছে কিনা তাই বলো।’
আবদুস সামাদ কোনও কথা না বলে টিভি অন করল। পর্দায় ভেসে উঠল আবদুল বয়াতীর মুখ। গলা ফাটিয়ে জারী গাইছে। এক দৃষ্টিতে বয়াতীর মুখখানা দেখল কিছুক্ষণ আবদুস সামাদ, ভল্যুম কমাল। আবার বাড়াল। তারপর সন্তুষ্টচিত্তে অফ করল টিভি। ঘুরে দাঁড়াল বদরুল হাসান সাহেবের দিকে।
হাসান সাহেব বিচিত্র মুখ ভঙ্গি করে ঘর থেকে বেরুলেন, পেছনে এল আবদুস সামাদ।
‘আপনার বিলটা পাঠিয়ে দেব, সার,’ বলল আবদুস সামাদ বদরুল হাসান সাহেবের পাশে হাঁটতে হাঁটতে।
‘হুম্ম’ জবাব দিলেন বদরুল হাসান।
সদর দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে আবার বদরুল হাসানের দিকে তাকাল আবদুস সামাদ। কী যেন বলতে গিয়েও বলল না। নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল মাথা নাড়তে নাড়তে।
লিভিং রুমে এসে ঢুকলেন বদরুল হাসান। ম্যান্টলপিসের ওপর রাখা ঘড়িটা গম্ভীর শব্দে বেজে উঠল।
গলার স্বর নিচু করে বদরুল সাহেব বললেন, ‘আবার শুরু করেছ? অনেক হয়েছে তো! আমার কথা কানে যায় না?’
কিন্তু ঘণ্টাটি একভাবে বেজে যেতে লাগল। ম্যান্টলপিসের দিকে হেঁটে গেলেন বদরুল হাসান। গলার স্বর সপ্তমে তুললেন, ‘বললাম তো অনেক হয়েছে। তারপরও যন্ত্রণা দাও। এত সাহস!’
দু’হাতে ঘড়িটাকে মুঠো করে ধরলেন তিনি, টান দিলেন জোরে। প্লাগসুদ্ধ ঘড়িটা ছিটকে এল দেয়াল থেকে। তারপর ওটাকে ধরে মস্ত আছাড় দিলেন বদরুল হাসান। ভেঙে টুকরো হয়ে গেল ঘড়ি। তাতেও রাগ কমল না। এবার পা দিয়ে পিষতে শুরু করলেন যন্ত্রটাকে। কিন্তু ভাঙা ঘড়ি থেকে ঘণ্টা ধ্বনি ভেসে এল অনবরত, যেন মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে কোনও পশু। বেশ সময় লাগল ঘণ্টার শব্দ থামতে। ভাঙা কাঁচ আর ছেঁড়া স্প্রিং-এর ওপর ততক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেন বদরুল হাসান। ঘামে মুখ ভিজে সপসপে, থর থর করে কাঁপছে শরীর। শান্ত হলেন তিনি ধীরে ধীরে। শরীরের কাঁপুনি থামলে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে, নিজের বেডরুমে গিয়ে ঢুকলেন।
দরজা বন্ধ করে বিছানায় গা এলিয়ে দিলেন বদরুল হাসান। নিজেকে ভঙ্গুর, ক্লান্ত এবং বিধ্বস্ত লাগছে। একটু পরেই ঘুমিয়ে পড়লেন তিনি। তবে মাঝে মাঝেই দুঃস্বপ্ন দেখে আঁতকে উঠলেন ঘুমের ঘোরে।
.
মি. বদরুল হাসান ব্যাচেলর মানুষ। উত্তরায় প্রাসাদোপম একটি বাড়িতে থাকেন। পৈতৃক সূত্রে অগাধ সম্পত্তির মালিক। ব্যাঙ্কে কত টাকা আছে নিজেও বোধহয় জানেন না। কাজেই পেটের ধান্ধা তাঁকে করতে হয় না। অবসরে তিনি বিভিন্ন পত্রিকায় কলাম লিখে পাঠান। কোনওটি ছাপা হয়, কোনওটি হয় না।
জীবন এবং পারিপার্শ্বিকতা সম্পর্কে কোনও আগ্রহ নেই বদরুল হাসানের। প্রতিবেশীদের খবর রাখার কোনও প্রয়োজন বোধ করেন না। তাঁর বন্ধু-বান্ধবের সংখ্যা এ কারণে হাতে গোনা। অবশ্য এতে কোনও অসুবিধে নেই বদরুল সাহেবের। পত্রিকায় লেখালেখি আর বাড়িতে ইলেকট্রিক বিভিন্ন গ্যাজেট নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই তাঁর সময় চলে যায়। অবশ্য বেশিরভাগ যন্ত্রই তিনি ভেঙে ফেলেন খুলতে গিয়ে। আর কাজটা যে একেবারে অজ্ঞতা থেকে করেন ঠিক তাও নয়। মনে হয় যান্ত্রিক কাঠামোগুলো ভেঙে তিনি এক ধরনের বিকৃত আনন্দ লাভ করেন।