বেঞ্চিতে বসা লোকটার দিকে আবার তাকাল ইলেন। সে চুপচাপ বসেই আছে, স্থির দৃষ্টি লেকে। হঠাৎ কী যেন একটা নজর কাড়ল ইলেনের। পানির ধারে কীসের একটা ছায়া, এগিয়ে আসছে। বিরতি দিল। এবারে ওটাকে পরিষ্কার দেখতে পেল ইলেন। বড় একটা ইঁদুর। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় লাফ মেরে উঠতে গেল ইলেন—নিজেকে দমন করল বেঞ্চির লোকটার কথা ভেবে। গলা দিয়ে বেরিয়ে আসতে চাওয়া চিৎকারটাকেও একই সঙ্গে গলা টিপে মারল।
যেন দুঃস্বপ্ন দেখছে ইলেন, বড়টার সঙ্গে আরও তিনটে ইঁদুর যোগ দিল। চাঁদের আলোয় ওদের বিকট ছায়া এবং কুৎসিত মুখগুলো দেখতে পাচ্ছে ইলেন। সিমেন্টের রাস্তায় প্রাণীগুলোর থাবার আওয়াজ উঠল। গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিতে ইচ্ছে করল ইলেনের, মন চাইল ছুট দেয়। কিন্তু বেঞ্চিতে বসা লোকটার ভয়ে কিছুই করতে পারল না।
লোকটা পাথরের মূর্তি হয়ে বসে আছে বেঞ্চে, ইঁদুরগুলো তার কাছ থেকে তিন হাত দূরেও নেই। ওগুলোকে নিশ্চয় দেখতে পাচ্ছে সে, ভাবল ইলেন। কিন্তু তার মাঝে কোনও ভাবান্তর নেই। কেমন লোক এ?
ইঁদুরের দিকে চোখ ফেরাল ইলেন। ওরা যেন সম্মোহন করেছে ওকে ঝোপে, দুই ফুট দূরে খসখস একটা শব্দ হলো। চিৎকার বন্ধ করার জন্য মুখে সোয়েটার চেপে ধরল ইলেন। যদি ওর দিকে ছুটে আসে কোনও ইঁদুর? ধারাল নখ বাগিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে?
এমন সময় তীব্র আতংক নিয়ে ইলেন দেখল লেকের ধারের চারটে ইঁদুর ওকে লক্ষ্য করে এগিয়ে আসছে। ওদের ধারাল মুখগুলো যেন উঁচিয়ে আছে ইলেনের দিকেই। লম্বা লেজ নড়ছে ডানে-বামে।
চিৎকার দিল ইলেন। উঠে দাঁড়াল বেঞ্চির লোকটা। ঝোপের দিকে আসছে। হাঁচড়েপাঁচড়ে সিধে হলো ইলেন। পিছিয়েছে এক কদম, একটা পা গিয়ে পড়ল গভীর একটা গর্তে। এটা ইঁদুরের গর্ত। ডজন খানেক ইঁদুরের বাচ্চা ব্যথা এবং ভয়ে কিচকিচ্ করে উঠল। পিলপিল করে বেরিয়ে এল গর্ত ছেড়ে। ছড়িয়ে পড়ল সর্বত্র। এক ঝটকায় গর্ত থেকে পা বের করে আনল ইলেন। আবার পিছিয়েছে, ওর পা চাপা পড়ে ভর্তা হয়ে গেল একটি বাচ্চা ইঁদুরের নরম শরীর। মরণ যন্ত্রণায় কিইইচ করে উঠল ওটা। ইলেন গলা ফাটিয়ে চেঁচাতে লাগল।
লোকটা ক্রমে কাছিয়ে আসছে। ঝোপ থেকে বেরিয়ে পড়ার প্রাণপণ চেষ্টা করল ইলেন। কিন্তু প্রচণ্ড ভয়ে জমে যাওয়া দুর্বল হাঁটু যেন সাড়া দিতে চাইছে না। কোনও মতে ঘন ঝোপঝাড় ঠেলে বেরিয়ে এল ও, পা রাখল রাস্তায়।
লোকটা দেখে ফেলেছে ইলেনকে। আরও কাছে চলে এসেছে সে। চাঁদের ম্লান আলোয় তার মুখ দেখতে পেল ইলেন। ভয়ে শরীরের সব কটা রোম দাঁড়িয়ে গেল। ওটা মোটেই মানুষের মুখ নয়! ওটা একটা ইঁদুরের মস্ত মুখ, মুখটা নড়ছে, সেইসঙ্গে নড়ছে মুখের দু’পাশের গোঁফ।
ঘুরেই ছুট দিল ইলেন। প্রচণ্ড ভয়ে দিশাহারা হয়ে দৌড়াতে লাগল ও। পেছনে ভেসে এল অসংখ্য ইঁদুরের ভয়ংকর কিচকিচ নিনাদ।
ছুটতে ছুটতে পার্কের ‘এক্সিট’ লেখা গেটের প্রায় কাছাকাছি এসে গেল ইলেন। আর মাত্র দশ গজ। তারপরই ওর মুক্তি। আশ্চর্য! গেটের কাছে কেউ নেই। একজন ভ্রমণকারীও দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু তাতে কী? ইলেন তো এখনই বেরিয়ে পড়বে। হঠাৎ ওর কলজে হিম হয়ে গেল ঠিক ওর পেছনে তীব্র কিইইচ শব্দ হতে। আঁতকে উঠে পাঁই করে ঘুরল ও। ভয়ংকর চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইঁদুর-মানব। জ্বলজ্বল করছে চোখ। দৃষ্টিতে বিকট উল্লাস। কই, দানবটার ছুটে আসার শব্দ তো পায়নি ও। ইলেনের মুখ হাঁ হয়ে গেল, চিৎকার দেবে। লম্বা, ধারাল থাবা আছড়ে পড়ল মুখে। চিৎকারটা আর মুখ ফুটে বেরুতে পারল না। তার আগেই আঁধার হয়ে এল ইলেনের দুনিয়া।
যন্ত্রণা
মি. বদরুল হাসান চল্লিশ পেরিয়েছেন আরও বছর পাঁচেক আগে। উচ্চতা মাঝারী, ওজন তিন মণের কাছাকাছি। মুখখানা থলথলে, মাংসের চাপে চোখ দু’টো ভেতরে ঢুকে আছে। এই মুহূর্তে তিনি চোখ কুঁচকে রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে আছেন বসার ঘরের এক কোণে রাখা একুশ ইঞ্চি সনি কালার টিভির দিকে। ওদিকে খানিকক্ষণ অগ্নিদৃষ্টি বর্ষণ করে কটমট করে চোখ ফেরালেন আবদুস সামাদের দিকে। আবদুস সামাদ হাড়গিলে চেহারার, তবে চোখের তারায় শিশুসুলভ একটা সরল ভাব আছে। সে মি. বদরুল হাসানের ত্রিশ হাজার টাকা দামের দামী কার্পেটের ওপর হাত পা ছড়িয়ে বসেছে, সামনে একটা টুল বক্স, হরেক রকম যন্ত্রপাতি, গুনগুন করে ‘ভালবাসিয়া গেলাম ফাঁসিয়া’ গাইছে আর টুল বক্স নিয়ে কী যেন খুটুর খাটুর করছে।
রাগে বদরুল হাসান সাহেবের গা জ্বলে যাচ্ছে। আবদুস সামাদের মত নিম্ন শ্রেণীর একটি লোক তাঁর ঘরের মেঝেতে হাত পা ছড়িয়ে বসেছে, ব্যাপারটা সহ্য করতে পারছেন না তিনি। কিন্তু নিজের স্বার্থেই নিম্ন শ্রেণীর এই লোকটিকে তাঁর কিছুক্ষণের জন্য সহ্য করতেই হবে।
আবদুস সামাদ নোংরা একটা ত্যানা দিয়ে হাত মুছল, তারপর আড়মোড়া ভেঙে তাকাল বদরুল হাসান সাহেবের দিকে।
‘সার, আজ কেমন আছেন?’
বদরুল সাহেবের বাম দিকের ভ্রুটা টকাশ করে লাফ দিল। আমি কেমন আছি তা তোমার পরে জানলেও চলবে। আগে বলো হারামজাদা টিভিটা আমাকে আর কত ভোগাবে। ওটার পেছনে আজ আবার কত খনাতে হবে?’
আবদুস সামাদ টিভি সেটের দিকে দ্রুত একবার নজর বোলাল, তারপর চোখ ফেরাল বদরুল হাসানের দিকে। ‘ওটার টিউব জোড়া গেছে। অসিলেটারের অবস্থাও খারাপ। নতুন ফিল্টারও লাগাতে হয়েছে।