অরিন্দম গুহ এরপর তার স্ত্রীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। বেশ সুন্দরী মহিলা। এককালে হয়তো মডেলিং করতেন। ধারাল, কাটাকাটা চেহারা! মেকআপ ছাড়াই তার ঝলমলে তুক থেকে দ্যুতি ছড়াচ্ছিল। বনেদী ঘরের বউরা এরকমই হয়। তবে মিসেস গুহর চোখের তারায় কালি দেখে বুঝলাম ঠিকমত ঘুম হয় না তার। দুশ্চিন্তায় ভুগছেন। ভ্যাম্পায়ারের ভয়েই হয়তো।
গুহর কিশোর দুটি ভাই-বোনও আছে। ছেলেটির ১৬/১৭ হবে বয়স, মেয়েটি ভাইয়ের চেয়ে ২/৩ বছরের ছোট। বড় ভাইয়ের রূপ পেয়েছে তারাও। ওদেরকেও খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত লাগছিল।
এখানে আমার মেয়েটি শুধু নেই, বললেন অরবিন্দ গুহ! ও হাসপাতালে। হপ্তাখানেক আগে ভ্যাম্পায়ারের হামলার শিকার হয়েছে আমার পাঁচ বছরের রূপা। এ কথা আপনার এজেন্সিকে জানিয়েছিও চিঠিতে। তবে প্রাণে বেঁচে গেছে আমার মেয়ে। ওই মোতির জন্যে, বিশালকায় একটা ডোবারম্যানের দিকে ইঙ্গিত করলেন তিনি, কুকুরটা আমার পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিল। নিঃশব্দে। দেখে লাফ মেরে উঠলাম। ওটা কখন চলে এসেছে খেয়ালই করিনি।
ঘটনাটা পরে বললেও হবে, দ্রুত বলে উঠলাম আমি। ভ্যাম্পায়ারের কথা উচ্চারণ করা মাত্র মিসেস গুহর মুখ সাদা হয়ে গেছে। শুধু মিসেস গুহ নয়, উপস্থিত। সবার চেহারায় ভয়ের ছাপ ফুটে উঠল। কিছু একটা ঘটার আশঙ্কায় আতঙ্কিত হয়ে আছে যেন সবাই। ভ্যাম্পায়ারের শিকার হবার ভয়? ভাবলাম আমি।
পরিচয় পর্ব শেষে দেখিয়ে দেয়া হলো আমার ঘর। বেশ বড় রুম, অনেক উঁচতে ছাদ, বিছানাটা ছোটখাট ফুটবল খেলার মাঠের মত। তিনতলার এই ঘরের বিরাট জানালা দিয়ে গুদের জমিদারির অনেকখানি দেখা যায়।
হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। পোশাক পাল্টে নিচে চললাম আমার নিমন্ত্রণকর্তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। প্রকাণ্ড বৈঠকখানায় আমার জন্যে অপেক্ষা করছিলেন মি. গুহ। ভজনখানেক সোফা সুবিন্যস্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা, চারটে অপূর্ব সুন্দর ঝাড়বাতি ঝুলছে ছাদ থেকে। একেকটা ছোটখাট গাছের মত।
আরাম করে গা এলিয়ে দিলাম তুলতুলে সোফায়। সূর্য অস্ত যাচ্ছে গোধূলি বেলার আবিরে শেষবারের মত পৃথিবীকে রাঙিয়ে। এক চাকরকে ড্রিংকস আনতে হুকুম দিলেন গুহ। তারপর শুরু করলেন তার গল্প।
আপনি শুনেছেন নিশ্চয়ই এক সময় সোনারগাঁয়ে আমাদের বিশাল জমিদারী ছিল। এ বাড়িটি আমার প্রপিতামহের। অনেকদিন এ বাড়িতে কেউ ছিল না। আমরা গত বছর থেকে থাকতে শুরু করেছি এখানে। আমাদের জমিদারী খতম হয়ে যায় আমার প্রপিতামহের আমলে। সোনারগাঁয়ের প্রায় অর্ধেকটাই আমাদের ছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বেশিরভাগ সম্পত্তি বেদখল হয়ে যায়। আমার বাবা এ দুঃখ সইতে না পেরে হার্ট-অ্যাটাক করে বসেন। বাবাকে নার্সিংহোমে ভর্তি করে আমরা এখানেই থাকতে শুরু করি। বাবা অবশ্য চাননি আমরা এ বাড়িতে থাকি। তিনি বারবার অন্য কোথাও থাকার কথা বলছিলেন আমাদেরকে। আমার মনে হচ্ছিল তিনি কিছু একটা গোপন করছেন।
এ সময়ে ড্রিংকস নিয়ে এক চাকর ঢুকল, চুপ হয়ে গেলেন মি. গুহ। গ্লাসে ঠকে আমরা চিয়ার্স বলে ড্রিংকস পান করলাম। এত চমৎকার মদ বহুদিন পান করিনি।
চাকর চলে যাবার পরে আবার শুরু করলেন গুহ। আমি বাবাকে বহুবার জিজ্ঞেস করেছি কেন তিনি আমাদেরকে পূর্ব-পুরুষের বাড়িতে বাস করতে দিতে নারাজ। কেন বলছেন এ শহর ছেড়ে অন্য কোথাও গিয়ে থাকতে। কিন্তু বাবা জবাব দেননি। বাবার জেদের কারণে আমরা সোনারগা ছেড়ে ঢাকা চলে আসি।
তবে বাবার সঙ্গে তর্ক করা উচিত হয়নি আমার। রাগারাগি করে দ্বিতীয়বার হার্ট-অ্যাটাক করে বসেন তিনি। আর এবারের অ্যাটাকে বাবা ভয়ানক অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিন দিন পরে মারা যান তিনি।
মৃত্যুর আগের দিন বাবা ডেকে পাঠিয়েছিলেন আমাকে। ডাক্তারদের নিষেধ সত্ত্বেও দরজা বন্ধ করে কথা বলেছেন আমার সঙ্গে। ফিসফিস করে ভয়ানক এক গল্প শুনিয়েছেন। গায়ের সমস্ত রোম খাড়া হয়ে গিয়েছিল গল্পটা শুনে।
বাবার কাছে জানলাম আমার প্রপিতামহ বিক্রান্ত গুহ চৌধুরী এক সময় প্রবল প্রতাপে সোনারগাঁয়ে জমিদারী চালাতেন। তিনি ছিলেন প্রচণ্ড বদরাগী এবং কুটিল স্বভাবের অত্যন্ত নিষ্ঠুর একজন মানুষ। সোনারগাঁয়ের মানুষের জীবন, তাদের মধ্যে বিক্রান্তের স্ত্রী-পুত্র-কন্যারাও রয়েছেন, নরক করে তুলেছিলেন তিনি। সবাই তাকে যেমন ভয় পেত ঘৃণাও করত তেমন। বেশ কয়েকবার তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়। প্রতিবারই অলৌকিকভাবে বেঁচে যান আমার প্রপিতামহ।
আমার প্রপিতামহ কেমন নিষ্ঠুর ছিলেন তার একটা উদাহরণ দিই। একদিন তিনি বসে আছেন, তার নায়েবকে হুকুম করেছেন গরম জল আনতে। পায়ে বাত হয়েছিল। গরম জলের সেঁক দেবেন। এখানে একটা কথা বলি, নায়েবের পদমর্যাদা উঁচু ধরনের হলেও বিক্রান্ত গুহ চৌধুরীর কাছে তিনি চাকরের চেয়ে বেশি কিছু ছিলেন না। নায়েব মশাইকে দিয়ে তিনি নান্স ফাইফরমাশ খাটাতেন। যা হোক, নায়েব জল নিয়ে এসেছেন গামলা ভর্তি করে। বুড়ো মানুষ। হাত কাঁপছিল। গরম জল খানিকটা লকে বিক্রান্ত গুহ চৌধুরীর পায়ে পড়ে যায়। সাথে সাথে তারস্বরে চিৎকার দিয়ে ওঠেন তিনি। রাগে উন্মাদ হয়ে চাকরদেরকে হুকুম করেন নায়েবকে বেঁধে ফেলার জন্যে। তারপর নায়েবকে ছুরি দিয়ে এলোপাথাড়ি কোপ দিতে শুরু করেন প্রপিতামহ। রক্তক্ষরণে মারা যান নায়েব মশাই। আপনিই বলুন-এরচে নিষ্ঠুরতা হতে পারে? আবার বিরতি পড়ল চাকর ঘরে ঢোকায় গ্লাস ভরে দিয়ে চলে গেল সে। গল্প ক করলেন প্রহ, নায়েব মশাই হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে প্রাণভিক্ষা চাইছিলেন তার মনিবের কাছে। কিন্তু অসহায়ের সে ফরিয়াদ কানে তোলেননি বিক্রান্ত। মারা যাবার আগ মুহূর্তে নায়েব শিকদার অভিশাপ দিয়ে গেলেন আমার প্রপিতামহকে। শপথ করলেন আবার ফিরে আসবেন তিনি ভ্যাম্পায়ার রূপে। তখন প্রতিশোধ নেবেন বিক্রান্ত এবং তার পরিবারের ওপরে। তারপর মারা গেলেন তিনি। এ ঘটনার মাস ছয়েক পরে, একদিন সকালে বিক্রান্ত গুহ চৌধুরীকে তার শোবার ঘরে পাওয়া গেল মৃত অবস্থায়। গলা ফালাফালা করে ছেড়া, রক্তে ভেসে যাচ্ছে শরীর। কে বা কারা এই নৃংশংস কাণ্ড ঘটিয়েছে বোঝা গেল না। তবে ঘরের দরজা-জানালা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল। হত্যাকারী দরজা-জানালা না ভেঙে ভেতরে ঢুকল কি করে? চুপ হয়ে গেলেন অরিন্দম। স্মৃতিগুলোকে মনে করার চেষ্টা করছেন। প্রপিতামহের মৃত্যুর ত্রিশ বছরের মধ্যে পরিবারের তিন সদস্যের একই রকম মৃত্যু ঘটে এ বাড়িতে। প্রত্যেকেরই গলা ছিল ফালা ফালা করে ভেঁড়া, যেন কেউ তীব্র আক্রোশে ছিঁড়ে নিয়েছে কণ্ঠনালী। আর প্রত্যেকের মৃত্যু ঘটেছে বন্ধ ঘরের মধ্যে দুটি ক্ষেত্রে অজানা হত্যাকারীর শিকার হয়েছে দুই শিশু। শেষজন ছিল মহিলা! এদের শরীর ছিন্নভিন্ন করে ফেলা হয়েছিল। কেউই হত্যাকারীকে দেখেনি বা ঘটনা কখন ঘটেছে বলতে পারেনি। কারণ ঘটনা যে ঘটছে তা টেরই পায়নি কেউ।