আমি আসলে যাব নওগাঁ, জানালার বাইরে চোখ রেখে জবাব দিলাম। রাজশাহী পর্যন্ত টিকেট কিনেছি। তবে তাড়াহুড়োর কারণে রিজার্ভেশন করতে পারিনি। আমার নামটা লিখে রাখবেন এ কম্পার্টমেন্টের জন্যে?
অবশ্যই, স্যার, বিনয়ের সাথে বলল সে। আপনার নামটা বলুন? জি, এস শিকদার, বললাম আমি।
রেজিস্ট্রেশন চার্টে আমার নাম লিখে নিল টিকেট চেকার, সই করে চলে গেল। কয়েক মিনিট পরে হুইশল শোনা গেল ট্রেনের, দুলে উঠল দানবটার শরীর। চলতে শুরু করেছে তুর্ণা। কিছুক্ষণের মধ্যে শহর থেকে বেরিয়ে এল ট্রেন, দুপাশে দিগন্ত বিস্তৃত ধানক্ষেত রেখে ছুটছে। আপনি নওগা থাকেন? হঠাৎ প্রশ্ন করে বসল আমার সঙ্গী।
ফিরলাম ভদ্রলোকের দিকে। মাসুদ রানা রেখে দিয়েছে সে, আগ্রহ নিয়ে চেয়ে আছে আমার দিকে। মৃদু গলায় বললাম, না। ওখানে ব্যবসার কাজে যাচ্ছি।
ফ্যান ঘুরছে ফুল স্পীড়ে, জানালা দিয়ে বাতাস আসছে, তারপরও দরদর করে ঘামছে লোকটি। বহুরঙা একটা রুমাল দিয়ে মুখ আর ঘাড় মুছল সে।
খোদাকে শুকরিয়া। ট্রেন ছাড়ল অবশেষে, নীরবতা ভেঙে বলল সহযাত্রী।
খোদাকে শুকরিয়া কেন? বললাম আমি। এ দেশে ট্রেন লেট হবার কথা সবাই জানে। তবে খুব বেশি লেট কখনোই করে না।
না! বলল সে। আমি রেলওয়ের পাংচুয়ালিটি নিয়ে ভাবছি না। ভাবছি নিজের জীবন নিয়ে।
আপনার জীবন নিয়ে? অবাক হলাম আমি।
হ্যাঁ, নিজের জীবন নিয়ে, নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল সে।
উঠে দাঁড়াল আমার সহযাত্রী, দরজার কাছে গেল। খুলল কপাট। করিডরের চারপাশে একবার চোখ বুলাল। তারপর সন্তষ্টচিত্তে ফিরে এল নিজের জায়গায়। চারদিকে একবার তাকালাম আমি, তারপর চোখ ফেরালাম জানালায়।
লোকটি বোধহয় ভেবেছিল তার জীবন সঙ্কটের কথা শুনে খুব বেশি প্রভাবিত হইনি আমি, হয়তো তার কথা বিশ্বাসই করিনি। তাই এবার সেধে নিজের পরিচয় দিল সে।
আমার নাম জীবন, বলল সে। জীবন চৌধুরী।
আচ্ছা, জানালা থেকে মুখ না ঘুরিয়েই বললাম।
আমি একজন শখের গোয়েন্দা, বলে চলল সে, ঢাকার একটি নামকরা প্রাইভেট এজেন্সিতে আছি।
বেশ, এ ছাড়া আর কিছু বলার মত খুঁজে পেলাম না আমি।
শার্লক হোমসের মত কাজ-কারবার আমাদের। গোয়েন্দা শার্লক হোমসের নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই?
হুঁ, বললাম আমি। কে না শুনেছে?
দ্য সাসেক্স ভ্যাম্পায়ার গল্পে শার্লক হোমস যেভাবে একটি চিঠি পায়, ওরকম একটি চিঠি সম্প্রতি পাই আমি এক প্রাক্তন জমিদারের কাছ থেকে। তার আসল নামটা বিশেষ কারণে গোপন রাখছি। ধরুন, তার নাম মি. অরিন্দম গুহ।
এ লোক গোয়েন্দা হোক বা না হোক তবে মাসুদ রানা যে খুব পড়ে তাতে সন্দেহ নেই, মনে মনে ভাবলাম আমি।
যমুনা ব্রিজ পার হচ্ছে ট্রেন, শব্দের জন্যে চুপ করে থাকল চৌধুরী। ব্রিজ পার হবার পরে বলল, চিঠির প্রথম কয়েকটি লাইন ছিল অবিকল সাসেক্স ভ্যাম্পায়ার গল্পের মত। গুহ জানালেন তার পরিবার এক ভ্যাম্পায়ারের আতঙ্কে অস্থির। ভ্যাম্পায়ারের কারণে তাদের জীবন থেকে শান্তি উধাও। রাতের ঘুম হারাম হয়ে। গেছে। মি. গুহ আমাদের এজেন্সির কাছে একজন গোয়েন্দা ভাড়া করতে চাইলেন। বললেন সবচে সেরা গোয়েন্দাকে যেন তাদের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়। কারণ তারা ভয় পাচ্ছেন ভ্যাম্পায়ার আবার হামলা করতে পারে।
থামল জীবন চৌধুরী, কপালের ঘাম মুছে আবার শুরু করল, চিঠির বিষয়বস্তু নিয়ে বস্ আমাদের কয়েকজন গোয়েন্দাকে নিয়ে আলোচনায় বসলেন। মি. অরিন্দম গুহর ব্যাকগ্রাউন্ড ঘেঁটে জানা গেল, ওটা ফালতু কোন চিঠি নয়। শেষে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো, একজন গোয়েন্দাকে পাঠানো হবে মি. গুহর বাড়িতে। বস্ শরাফত আলি এজেন্সির সবচে করিল্কর্মা লোক হিসেবে আমাকে বিশেষ স্নেহ করেন বলেই হয়তো রহস্য অনুসন্ধানের দায়িত্ব চাপিয়ে দিলেন আমার কাঁধে। গর্বের হাসি ফুটল চৌধুরীর ঠোঁটে।
আমি চুপ করে তার কথা শুনছি। তবে দৃষ্টি জানালার বাইরে।
যাক, আমি পরদিনই বাসে চেপে গেলাম সোনারগা শুরু করল শখের গোয়েন্দা। টার্মিনালে আমার জন্য গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন মি. গুহ। গাড়িতে চড়ে পৌঁছে গেলাম তার প্রাসাদোপম বাড়িতে।
শহরের উপকণ্ঠে মি. গুহের প্রাসাদ। তিনতলা বাড়ি। ত্রিশটিরও বেশি রুম, কমপক্ষে পঞ্চাশ বিঘা জমির ওপর বাড়িটি। তবে বোঝাই যাচ্ছিল বহু পুরানো বাড়ি, রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে প্রায় জরাজীর্ণ অবস্থা। অবশ্য আজকালকার যুগে এতবড় বাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ করা মুখের কথা নয়। প্রচুর খরচের ব্যাপার। আর যদ্র জানতাম গুহদের আর্থিক অবস্থাও ইদানীং ভাল যাচ্ছে না। বিশাল সদর দরজার সামনে এসে হঠাৎ ধাক্কা খেলাম। দরজায় মানুষের একটা কঙ্কাল ঝুলছে। ধাক্কাটা হজম করে নিলাম মনে মনে। পরিচয় হলো মি. গুহর সাথে। সুদর্শন, মাঝারী গড়নের এক ভদ্রলোক। মাথার চুল রাতের মত কালো, কোঁকড়ানো। বয়স বত্রিশ/তেত্রিশ হবে। মি, গুহই তার পরিবারের অন্যান্যদের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। সকলে যেন আমার অপেক্ষাতেই ছিল।
মি. গুহর পরিবারের সদস্যদেরকে দেখলাম আগ্রহ নিয়ে। প্রথমে পরিচয় হলো গুহর মার সাথে। লম্বা, হাড্ডিসার চেহারার ভদ্রমহিলা। মাথার চুল প্রায় সবটাই পেকে গেছে। অথচ বয়স পঞ্চাশের বেশি হবে না। বয়সের তুলনায় অনেক বুড়ি লাগছিল তঁাকে, চামড়ায় ভঁজ পড়ে গেছে। শুধু চোখজোড়া, ঝকঝকে, কালো তারা থেকে যেন বিচ্ছুরিত হচ্ছিল শক্তি।