মারা গেছে ভ্যানিং। ওর খুনী অদৃশ্য। দূর থেকে লোকজনের হৈ-হল্লা ভেসে আসছে। আমার এখন দরজা খুলে সাহায্য চাওয়া প্রয়োজন।
কিন্তু পারলাম না। ঘরের মাঝখানে দাড়িয়ে চিক্কার দিতে থাকলাম। আমার দৃষ্টি ক্রমশ অস্পষ্ট হতে শুরু করল। মনে হলো ঘরের সবকিছু বন বন ঘুরতে শুরু করেছে-রক্তমাখা বই; শুকনো মমি, ওটার বুকেও রক্ত লেগে গেছে ধস্তাধস্তির সময়; আর রক্তাক্ত, অসাড় ওই মাংসল জিনিসটা। সব কেমন ঘোলাটে হতে লাগল।
ঠিক তখন, ওই সময় যেন চেতনা ফিরে পেলাম আমি। ঘুরেই দিলাম দৌড়।
এর পরের ঘটনা অস্পষ্টভাবে মনে পড়ছে আমার। মৃত ভ্যানিংকে রেখে চিৎকার করতে করতে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ি আমি। যেন মুখোশধারী সেই পিশাশদেবতা তাড়া করেছে আমাকে। দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাই রাস্তায়। কারা যেন আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল।
তার পরদিনই নিউ অরলিন্স ছেড়ে চলে আসি আমি। ভ্যানিং-এর ব্যাপারে কোন খোঁজ-খবরও নিইনি। এমনকি খবরের কাগজও কিনিনি। ফলে জানা সম্ভব হয়নি পুলিশ ভ্যানিং-এর লাশ খুঁজে পেয়েছিল কিনা বা মৃত্যু রহস্য তদন্ত করেছিল কিনা। এ ব্যাপারে জানার কোন আগ্রহও নেই আমার। বলা উচিত, সাহস নেই।
এ ঘটনার কি ব্যাখ্যা দেব আমি? নিজেকে প্রবোধ দিই-মাতাল ছিলাম। আর মাতালরা নেশার ঘোরে কত কিছুই না দেখে। কিন্তু সেই ব্যাপারটিকে কি করে অস্বীকার করব আমি? সেই যে, পিশাচদেবতার মুখটা চেপে ধরেছিলাম আমি এক হাতে, আর ওটা পিছলে গেল।
সেই মুহূর্তে, যখন আমি রক্তাক্ত সরীসৃপটার নাক চেপে ধরেছিলাম, স্পষ্ট অনুভব করতে পারছিলাম, আমার হাতের নিচে ওটা কোন মুখোশ নয়, জ্যান্ত একটা প্রাণী!
[মূল: রবার্ট ব্লচের দ্য সিক্রেট অভ সেবেক]
ভ্যাম্পায়ারের প্রতিহিংসা
গরম! প্রচণ্ড গরম পড়েছে রাজধানীতে। ঢাকা শহরে গ্রীষ্মের সময় এমনিতেও বেশি তাপমাত্রা থাকে। তবে গত কয়েক বছরে এত গরম পড়েনি। তাপমাত্রা পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রীতে উঠে গেছে। ভয়াবহ গরমে ইতিমধ্যে মারা গেছে দশ জন। সকাল নটার পরে রাস্তায় বেরুনোর কথা ভাবলেই শুকিয়ে যায় কলজে। রাস্তার পিচ গলতে শুরু করে দশটা থেকে। এগারোটার পরে ঢাকা প্রায় ভুতুড়ে নগরীতে পরিণত হয়। লোকজন মগজ ফোটানো গরমে একান্ত বাধ্য না হলে বেরুতেই চায় না। রাস্তা দিয়ে তীব্র ভাপ ওঠে, গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দেয়। শুয়োরের মত দরদর করে ঘামে শরীর। যতই পানি খাও, কিছু লাভ নেই। চোষ কাগজের মত পানিটুকু শুষে নেবে গা, জিভ শুকনো, খরখরেই থাকে। আর কুঁকড়ে যায় ঠোঁট। সারাক্ষণ সাহারা মরুর তেষ্টা বুকের ভেতর। তীব্র উত্তাপ শরীর থেকে শুষে নেয় শক্তি। কুকুরের মত হ্যা-হ্যাঁ করে হাঁপাতে থাকে মানুষ।
পাগল করা গরমের সঙ্গে যোগ হয়েছে ধুলো। ধুলোময় বাতাসে শ্বাস না নিয়ে উপায় নেই। নাক-মুখ দিয়ে ঢুকে পড়ে ধুলো, বন্ধ হয়ে আসে দম।
গরম এবং ধুলো দুই প্রবল প্রতাপশালী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করা মুশকিল। মাথা ঘুরে পড়ে যাবার সম্ভাবনা প্রবল, তবুও এমন দাবদাহের মাঝে বেরুতে হয়েছে। বিশেষ কাজে। ঘামে ভিজে পিঠের সঙ্গে লেগে রয়েছে জামা। জিভ শুকিয়ে খরখরে। নাকে ধুলোর সমুদ্র, হাজারটা সূর্য যেন একযোগে তাপ আর আলো ছড়াচ্ছে, তাকানো। যায় না।
চোখে সানগ্লাসটা ভাল মত এটে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের দিকে পা বাড়ালাম আমি। ভেতরটা অপেক্ষাকৃত ঠাণ্ডা। তবে খুব বেশি নয়। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে তূর্ণা। চারদিকে একবার চোখ বুলালাম। প্লাটফর্ম যথারীতি জনারণ্য। জীবিকা আর প্রয়োজনের তাগিদে বেরুতেই হয় মানুষকে। যাত্রীদের কেউ কেউ ভাড়া নিয়ে বচসা করছে কুলিদের সঙ্গে, হকারদের হাঁকডাক, সব মিলে নরক শুলজার। বুকিং অফিস থেকে টিকেট কিনলাম একটা, এগোলাম ট্রেনের দিকে।
সেকেন্ড ক্লাস কম্পার্টমেন্টগুলো এরই মধ্যে ভরে গেছে। ওদিকে আর দ্বিতীয়বার তাকালাম না। ফার্স্টক্লাস কম্পার্টমেন্টের টিকেট কিনেছি। ফাঁকা দেখে উঠে পড়লাম একটা কৃপে-তে।
না, কম্পার্টমেন্টটা সম্পূর্ণ খালি নয়। একজন সঙ্গী পেয়েছি আমি। এই গরমেও নীল সাফারি সুট পরা। লোকের বয়স ত্রিশবিত্রিশ হবে। মাসুদ রানার লেটেস্ট সিরিজে তার এ মুহূর্তে মনোযোগ।
জানালার ধারে বসে পড়লাম আমি। ভদ্রলোক বই রেখে ভুরু কুঁচকে তাকাল আমার দিকে। সম্ভবত জানালার পাশের সিট দখল করার ব্যাপারটি পছন্দ হয়নি তার।
মাফ করবেন, বিনীত গলায় বললাম আমি। এখানে কি কেউ বসবে?
না, সংক্ষেপে জবাব দিল সে।
লোকটির দিকে আর তাকালাম না। জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে রইলাম। একটু পরে আড়চোখে লোকটিকে লক্ষ করতে লাগলাম। আবার বইয়ে মনোনিবেশ করেছে সে। যাক, এখানে বসেছি বলে কোন আপত্তি করছে না। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। চা-অলার কাছ থেকে এক কাপ চা কিনে চুপচাপ চায়ের কাপে চুমুক দিতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পরে একজন কেরানী গোছের লোক ঢুকল আমাদের কম্পার্টমেন্টে। টিকেট চেক করবে। টিকেট চেকার প্রথমে ভদ্রলোকের কাছে গেল। দুজনের সংক্ষিপ্ত আলোচনা শুনে বুঝলাম ওই লোকের নাম মি. চৌধুরী, রাজশাহী যাচ্ছে। টিকেট চেকার এবার ফিরল আমার দিকে।
আপনিও রাজশাহী যাচ্ছেন দেখছি, বলল চেকার।