তবে আমি আরও অনেকদিন বাঁচতে চাই, ধারাল গলায় বললেন উইলড্যান। এই মমিটাকে অন্য কোথাও সরিয়ে ফেলতে বলেছিলাম। কারণ এটা অশুভ। এখানে এটাকে যে কাজে আনা হয়েছে তা কখনোই সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। কারণ আমি সেবেকের অভিশাপে বিশ্বাস করি।
আপনারা জানেন, সেবেকের মাত্র চার পুরোহিতের মমির সন্ধান মিলেছে। বাকিদের সন্ধান পাওয়া যায়নি কারণ খুব গোপনে তাদের কবর দেয়া হয়েছে। যারা এই চারটে মমির খোঁজ দিয়েছে তাদের সবার কপালেই জুটেছে নির্মম মৃত্যু। প্যারিংটন নামে একজনকে আমি চিনি। তৃতীয় মমির সন্ধান পেয়েছিল সে। অভিশাপের ব্যাপারটা সত্য কিনা তাই অনুসন্ধান করছিল প্যারিংটন। কিন্তু দেশে ফেরার পরে, রিপোর্ট প্রকাশ করার আগেই মারা যায় সে। তার মৃত্যুও হয়েছিল অদ্ভুতভাবে, লন্ডনের চিড়িয়াখানায়, ব্রিজের রেলিং ফস্কে, নিচে কুমিরের গর্তে পড়ে যায় প্যারিংটন। ওরা যখন তাকে উদ্ধার করে, ছিন্ন ভিন্ন বিকৃত লাশটাকে মানুষ বলে চেনার উপায় ছিল না।
ভ্যানিং তাকাল আমার দিকে। বেশ সিরিয়াস গলায় বলল, শুনলে তো সব কথা। এজন্যই তোমাকে এখানে ডেকে এনেছি আমি। একজন প্রেতশাস্ত্রবিদ এবং পণ্ডিত হিসেবে তোমার নিজস্ব মতামত চাই আমরা। এই মমিটাকে কি সত্যি ফেলে দেব আমরা? তুমি এই অভিশাপের গল্পে বিশ্বাস করো? আমি করি না, তবে অস্বস্তি হয় শুনলে। প্রচুর কাকতালীয় ঘটনার কথা আমি জানি, প্রীনের সত্যবাদিতার প্রতিও আমার অবিশ্বাস নেই। মমিটাকে দিয়ে আমরা কি করব বা করতে চেয়েছি সেটা মুখ্য ব্যাপার নয়। এতে হয়তো এটাকে অপবিত্র করা হবে। চাই না কোন দেবতা আমাদের ওপর গোস্বা করুক। কুমিরমুখো কোন প্রাণী আমার গলা কামড়ে দেবে তাও চাই না। এখন তুমি কি বলো?
আমার হঠাৎ সেই মুখোশধারী লোকটার কথা মনে পড়ে গেল। দেবতা সেবেকের ছদ্মবেশে সে এসেছিল।
লোকটার কথা ভ্যানিংকে জানালাম। কে সে? জিজ্ঞেস করলাম আমি। অসাধারণ ছদ্মবেশ নিয়েছিল সে।
ভ্যানিং-এর মুখ সাদা হয়ে গেল কথাটা শুনে। তার আঁতকে ওঠা দেখে মনে মনে অনুতপ্ত হলাম। এভাবে লোকটাকে ভয় না দেখালেও চলত।
আমি তো দেখিনি! শপথ করে বলেছি অমন কাউকে আমি পার্টিতে দেখিনি। লোকটাকে এক্ষুণি খুঁজে বের করতে হবে।
হয়তো ব্ল্যাকমেইল করতে এসেছিল লোকটা, বললাম আমি। তোমার কাছ থেকে টাকা হাতানোর তালে।
হতে পারে, কেঁপে গেল ভ্যানিং-এর গলা। অন্যদের দিকে ঘুরল সে।
তাড়াতাড়ি, বলল ও। অতিথিদের ঘরে যাও। সবার ওপর নজর বোলাও। ওই লোকটাকে খুঁজে বের করো। ধরে নিয়ে এসো আমার কাছে।
পুলিশ ডাকব? নার্ভাস ভঙ্গিতে প্রশ্ন করল রয়েস।
আরে বোকা, না। যাও যাও। শিগগির।
তড়িঘড়ি বেরিয়ে গেল চারজন। বাইরের করিডরে পায়ের আওয়াজ প্রতিধ্বনি হয়ে বাজল কিছুক্ষণ।
একটু নীরবতা। হাসার চেষ্টা করল ভ্যানিং। আমি বিমূঢ় হয়ে পড়লাম। মিশর নিয়ে যে স্বপ্ন আমি দেখি, কল্পনা করি, গল্প লিখি তা কি সব সত্যি? মুখোশধারী ওই লোকটার কথা বারবার ভাবছি কেন আমি? ওই অভিশাপের ব্যাপারটা কি সত্যি? নাকি ভ্যানিং আজগুবী একটা গল্প ফেঁদেছে।
হঠাৎ হালকা একটা শব্দ হলো…
বিদ্যুৎগতিতে ঘুরে দাঁড়ালাম, দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে আছে সেই মুখোশধারী কুমির-মানব। ওই, ওই যে সে! চেঁচিয়ে উঠলাম। সেই- টেবিলের গায়ে হেলে গেল ভ্যানিং, ছাই হয়ে গেছে মুখ। চৌকাঠের দিকে তাকাল সে, দৃষ্টি ফিরে এল আমার দিকে, উদ্ভ্রান্ত। মৃত্যুর ছায়া দেখলাম ওর চোখে।
কুমিরের মুখোশ পরা ওই লোকটা…আমি ছাড়া আর কেউ ওকে দেখেনি। একি আসলেই মুখোশধারী কেউ নাকি পিশাচদেবতা সেবেক স্বয়ং? তার কবর খোড়ার অপরাধে এসেছে প্রতিশোধ নিতে?
দোরগোড়ায় দাড়ানো মূর্তিটাকে আমার অশুভ এবং ভয়ঙ্কর মনে হলো। স্থির হয়ে আছে। হঠাৎ দড়াম করে শব্দ হতে দেখি কাঁপতে কাঁপতে ভ্যানিং আছাড় খেয়েছে মমির বাক্সটার গায়ে।
তারপর এত দ্রুত ঘটনাগুলো ঘটে গেল যে আমি নড়াচড়াও ভুলে গেলাম। সরীসৃপ আকৃতিটার দেহে বিদ্যুৎ খেলে গেল, ঢেউ খেলে যেন এগিয়ে এল সে। চোখের পলকে দাঁড়িয়ে পড়ল ভ্যানিং-এর দুমড়ে-মুচড়ে পড়ে থাকা শরীরের সামনে। সাদা আলখেল্লার আড়াল থেকে আত্মপ্রকাশ করল কঠিন, পাখির মত বাঁকানো দুটো হাত চেপে ধরল ভ্যানিং-এর দুই কাধ। হাঁ করল মুখোশধারী, খুলে গেল ক্ষুরধার দাঁতের সারি নিয়ে প্রকাণ্ড চোয়াল। নড়ে উঠল। এগোল ভ্যানিং-এর গলা লক্ষ্য করে।
বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রইলাম আমি বীভৎস দৃশ্যটার দিকে। দানবীয় নাকটা ঠেকে আছে ভ্যানিং-এর ঘাড়ে, কামড় বসাচ্ছে। মাথাটাই শুধু দেখছি আমি ক্যামেরা ক্লোজ-আপের মত।
মাত্র এক সেকেন্ডের মধ্যে ঘটনাটা ঘটল। সংবিৎ ফিরে পেলাম হঠাৎ। সাদা আলখেল্লার একটা আস্তিন ধরে ফেললাম, অন্য খালি হাতটা দিয়ে চেপে ধরলাম খুনীর মুখোশটা।
খুনেটা ঝড়ের গতিতে ঘুরল, নিচু করল মাথা। পিছলে গেল আমার হাত, এক মুহূর্তের জন্য ছুঁয়ে গেল কুমির-মানবের নাক, রক্তাক্ত চোয়াল।
তারপর, একটা ঝলক যেন দেখলাম আমি ঘূর্ণি উঠল হামলাকারীর শরীরে, চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি ভ্যানিং-এর রক্তাক্ত, ছিন্নভিন্ন শরীরের পাশে দাড়িয়ে চিৎকার শুরু করলাম।