০৩.
আমি শিপলু। আমার বয়স আট। আর আমার প্রাণের বন্ধু টুবলুর বয়সও আট। দুজনেই বড় মাউছা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্লাস থ্রীতে পড়ি। কিছুক্ষণ আগে আমরা দুজনে দারুণ একটা জিনিস আবিষ্কার করেছি। আমাদের বাসা থেকে প্রায় আধ মাইল দূরে একটা পুরানো ইটের ভাটা আছে। এখন আর ওখানে কেউ যায় না। কিন্তু আমি আর টুলু বাবা মার চোখ এড়িয়ে সুযোগ পেলেই ওখানে চলে যাই। চোর-পুলিশ খেলি। কখনও আমি হই চোর, টুলু পুলিশ। আবার টুলু চোর, আমি পুলিশ।
যা হোক, যা বলছিলাম। আজ দুপুরে, বাবা যখন অফিসে আর মা খাওয়াদাওয়া সেরে দিবান্দ্রিায় মগ্ন, এইসময় টুই টুই পাখির ডাকে বিছানা থেকে ভূতের মত নিঃশব্দে নেমে এলাম আমি। খিড়কির দরজা খুলে বেরিয়ে দেখি টুলু। ওর হাতে একটা ঝোলা। ওতে কি কি আছে সব চোখ বুজে বলে দিতে পারি আমি। একটা জংধরা পুরানো হ্যান্ডকাফ, (শিপলুর বাবা দারোগা। কাজেই এই জিনিসটা জোগাড় করতে কষ্ট হয়নি ওর। ওদের ভাড়ার ঘর থেকে হ্যান্ডকাফটা চুরি করেছে টুলু। চাচী এ ব্যাপারে কিচ্ছুটি টের পায়নি, মাহতাব চাচা তো নয়ই।) একটা লম্বা রশি (চোরের হাতে শুধু হ্যান্ডকাফ পরালেই চলবে না, তার কোমরে রশি বাধতেও হবে।) আর কিছু স্কচ টেপ যে চোর সাজে তার মুখ অন্যজন টেপ দিয়ে বেঁধে দেয়। চুরির সাজা আর কি।
তো টুলু আসতেই আমাদের গায়ে যেন পাখা গজাল। প্রায় উড়ে চলে গেলাম। গোপন আস্তানায়। আর সেখানে গিয়ে চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেল লোকটাকে দেখে। আমাদের চেয়েও বেঁটে লোকটা মাথায় কাকের বাসা, ডান পা-টা বাকা, মুখে কয়েকদিনের না কামানো দাডি। লোকট, ভোস ভোস করে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে ভাটির পশ্চিম দিকে, গুহামত জায়গাটায়। গুহা থেকে হাত দশেক দূরে আমাদের চোরপুলিশ খেলার স্থান। ওখানে আমাদের কিছু গোপন জিনিসপত্র আছে। দ্রুত সব পরীক্ষা করে দেখলাম। না ঠিক আছে, হারায়নি কিছু। কিন্তু বেঁটে বামনটার আকস্মিক অনুপ্রবেশে সাংঘাতিক বিরক্ত হলাম দুজনে। এ লোকটাকে এর আগে কখনও দেখিনি এদিকে। উড়ে এসে জুড়ে বসল নাকি? বেজায় মেজাজ খারাপ হলো। আর। তক্ষুণি মাথায় দারুণ একটা বুদ্ধি এল। টুলুকে ডেকে কানে কানে বললাম প্র্যানটার কথা। উত্তেজনায় চোখ বড় বড় হয়ে গেল ওর। জোরে মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল সে আমার কথায়। আর সময় নষ্ট না করে কাজে লেগে পড়লাম দুজনে।
লোকটার ঘুম কি গভীর রে, বাবা! আমাদের খিকখিক হাসি, পায়ের শব্দ কিছুই টের পাচ্ছে না। যখন একসাথে লাফিয়ে পড়লাম ওর বুকের ওপর এবং চট করে হ্যান্ডকাফ জোড়া পরিয়ে দিলাম হাতে, ধড়মড় করে জেগে গেল সে। উঠে বসতে গেল। কিন্তু আমি ওকে মাটির সাথে জোরে চেপে ধরে থাকলাম আর টুবলু দক্ষ হাতে লোকটার পা বেঁধে ফেলল দড়ি দিয়ে। দারোগার ছেলে হলে এ সব কাজ কারও কাছে শিখতে হয় না। লোকটা চেঁচামেচি শুরু করে দিল। কিন্তু আমি আর টুলু জোরে মুখ চেপে ধরে থাকলাম। টুবলু ঝোলা থেকে স্কচ টেপ বের করে কষে লোকটার মুখে লাগিয়ে ফেলল। এখন যতই চিৎকার করো আর শব্দ শোনা যাবে না। অসহায়ভাবে ঘেত ঘোত করতে থাকল লোকটা। মজা পেয়ে হাততালি দিলাম আমরা। কিন্তু এটুকু মজায় আমাদের হবে না, আরও মজা পেতে হবে। বিশেষ করে চোরদের শাস্তি দেয়ার মধ্যে দারুণ মজা আছে। যদিও সে সুযোগ আমরা কেউই পাই না। আমরা অনেক কিছুই করতে পারি না বড়দের চোখ রাঙানি আর থাপ্পড়ের ভয়ে। বড়রা যেটা করতে নিষেধ করে ঠিক সেই কাজটা করতে যে কি মজা তা যদি ওরা জানত! বাবা-মা আর বড় ভাইয়ার শাসনের ঠেলায় ওষ্ঠাগত প্রাণ আমার। টুবলুরও। ওর বড় বোনটা তো পান থেকে চুন খসলেই বেধড়ক পিট্টি লাগায় বেচারা টুলুকে। একটুও মায়া করে না। এজন্য বড়দের দেখতে পারি না আমরা। সবসময় ওদের অনিষ্ট করার চিন্তা গিজগিজ করে মাথায়। ইচ্ছে করে ওদের ধরে মারতে। কি শক্তিতে পারব না বলে সাহসে কুলোয় না। তবে একটা ধেড়ে ইদুরকে তো। পেয়েছি। এবার এটাকে নিয়ে একটু মজা করা যাক।
চড়ইভাতি খাওয়ার জন্য আমি আর টুলু আমাদের গোপন আস্তানায় ছোট হাঁড়ি-পাতিল, ম্যাচ ইত্যাদি সব রেখে দিয়েছি। করলাম কি, শুকনো ডাল পাতা কুড়িয়ে এনে তাতে আগুন জ্বালালাম। তার মধ্যে দুটো লোহার শিক খুঁজে দিলাম। মা তার লাকড়ির চুলোয় আগুন উস্কে দিতে এই শিকগুলো ব্যবহার করে। আমি একটা শিক রান্নাঘর থেকে চুরি করেছি আর টুবলু ওরটা রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়েছে।
দেখতে দেখতে লোহার শিকের ডগাটা লাল হয়ে উঠল। কিন্তু টুলু বলল তার শিকের ডগা সাদাটে রঙের না হওয়া পর্যন্ত ওটা সে তুলবে না। টিভির ছবিতে এভাবে লোহার শিক গরম করতে দেখেছে ও।
আমার শিকটা যথেষ্ট গরম হয়েছে। আমি ওটা দিয়ে বামনার পায়ে, হাতে আর মুখে ছাকা দিতে শুরু করলাম। টুলুও একটু পর তাই করতে লাগল। সেই সাথে দেখা গেল মজা।
টেপ দিয়ে মুখ বন্ধ বেঁটে লোকটা অদ্ভুত সব ভোতা, ফুপা শব্দ করতে লাগল। শরীর মোচড় খাচ্ছে মাটিতে কাটা সাপের মত। পা বাধা বলে উঠেও দাঁড়াতে পারছে না। ওর চোখ দুটো যেন বেরিয়ে আসবে কোটর ছেড়ে। চিবুক বৈয়ে বিশ্রী রঙের তরল পদার্থ টপটপ করে পড়তে শুরু করল। আমরা বাটকুলটার দশা দেখে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ি আর কি!