মমির বাক্সটার দিকে পা বাড়াল ভ্যানিং। অনুসরণ করলাম ওকে আমি।
ওকে আর বেশি কিছু ব্যাখ্যা করতে হলো না। যা বোঝার বুঝে নিয়েছি।
বাক্সটার ওপর প্রতিলিপি এবং চিহ্ন দেখে বোঝা গেল ওটার ভেতরে জনৈক মিশরীয় পুরোহিতের লাশ আছে। দেবতা সেবেকের পুরোহিত। সারাসেনিক রিচুয়ালস-এ এ সম্পর্কে বিস্তারিত লেখা আছে।
সেবেক সম্পর্কে যা জানি আমি চট করে মনে পড়ে গেল সব। প্রখ্যাত নৃবিজ্ঞানীদের মতে, সেবেক হলো মিশরের এক দেবতা, নীলনদের উর্বরতার দেবতা। যদি স্বীকত কর্তৃপক্ষের কথা সত্যি হয়, তাহলে সেবেকের চার পুরোহিতের মমি করা লাশের সন্ধান পাওয়া গেছে এ পর্যন্ত। যদিও এই দেবতার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে তার অসংখ্য মূর্তি এবং আকৃতি তৈরি হয়েছে, কবরে আঁকা হয়েছে ছবি। মিশরের বিজ্ঞানীরা সেবেক সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য উদঘাটন করতে পারেনি। শুধু নৃবিজ্ঞানী নুডভিগ প্রিন এ নিয়ে যাহোক কিছুটা এগোতে পেরেছিলেন। তাঁর লেখার কথা মনে পড়তেই হিম একটা স্রোত বয়ে গেল শিরদাঁড়া বেয়ে।
সারাসেনিক রিচুয়ালস-এ প্রিন বলেছেন মরুভূমি আর নীলনদের গুপ্ত উপত্যকার গোপন-কবরস্থান ঘুরে তিনি কি তথ্য পেয়েছেন সে সম্পর্কে।
ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত এক গল্পের বর্ণনা দিয়েছেন প্রিন। বলেছেন কিভাবে মিশরীয় পুরোহিতবাদ ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে ওঠে-কিভাবে পিশাচ দেবতাদের অনুগতরা সিংহাসনের পেছনে থেকে ফারাওদের শাসন করত এবং গোটা দেশ তাদের মুঠিতে পুরে রাখত। মিশরীয় দেবতা এবং ধর্মের গোটা ব্যাপারটাই ছিল গোপন বাস্তবতার ওপর ভিত্তি করে। অদ্ভুত শংকর জাতীয় প্রাণীরা হাঁটত পৃথিবীর মাটিতে; দানবীয়, বিকট ছিল তাদের চেহারা-আধা পশু আধা মানুষ। মানুষের শুধু সৃষ্টি ছিল না বিশালদেহী সাপ দেবতা সেট, প্রচণ্ড পেটুক বুবাস্টিস, এবং বিরাট অসিরিস কিংবা শিয়ালমুখো অ্যানুবিস কিংবা ওয়্যারউলফ।
প্রাচীন পুরুষরা প্রবল ক্ষমতা নিয়ে দেশ শাসন করত, পশুরা ছিল তাদের আজ্ঞাবহ। দেবতাদের ইচ্ছে করলেই তারা ডেকে পাঠাত। সেই দেবতাদের চেহারা ছিল মানুষের মত, মাথা পশুর।
যখন তারা মিশরে রাজত্ব করত তখন তাদের কথাই ছিল আইন। দেশ জোড়া ছিল শুধু দামী দামী মন্দির, দেবতাদের উদ্দেশে বলি দেয়া হত মানুষ। পশুমুখো দেবতারা সব সময় উন্মাদ থাকত রক্তের তৃষ্ণায়। অমরতু আর পুনর্জন্মের লোভে তারা দেব-দেবীকে তুষ্ট করত তাদের প্রবল খিদে মেটানোর ব্যবস্থা করে। মমিতে যেন পচন না ধরে এ জন্য মানুষের রক্ত মাখিয়ে দিত কফিনে। এজন্য কত মানুষকে যে জীবন দিতে হয়েছে তার হিসেব নেই।
প্রিন সেবেক দেবতার কথাও বিস্তারিত বলেছেন। পুরোহিতরা বিশ্বাস করত উর্বরতার দেবতা সেবেক অমর জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই দেবতা কবরে তাদের অনন্তকাল পাহারা দিয়ে রাখবে যতদিন না শেষ বিচারের দিন মৃত ব্যক্তিদের আত্মা কবর থেকে ওঠে, ততদিন। আর যারা তাদের কবরে, চিরদ্রিার শান্তি বিঘ্নিত করবে সেবেক সেই শত্রুদের ধ্বংস ডেকে আনবে। এজন্য পুরোহিতরা তাকে কুমারীদের উৎসর্গ করবে তার উদ্দেশে, এদের ছিঁড়ে খাবে সোনার কুমির। আর সে কুমির হলো দেবতা সেবেক স্বয়ং, যার শরীর মানুষের, মাথা কুমিরের।
উৎসবের সেই বর্ণনা বড় ভয়ানক। পুরোহিতরা সেই ভয়ঙ্কর উৎসবে তাদের প্রভুর মত কুমিরের মুখোশ পরে। প্রতি বছর, তাদের ধারণা, সেবেক নিজে এসে হাজির হয় মেমফিসের মন্দিরে, সবচেয়ে ক্ষমতাসম্পন্ন পুরোহিতদের সামনে আধা মানুষ আধা কুমিরের বেশে।
পুরোহিতরা বিশ্বাস করত সেবে তাদের কবর পাহারা দেবে। আর তাদের এই বিশ্বাসের বলি হতে হত ওই উৎসবের দিনে অগুনতি কুমারী মেয়েদের।
প্রিন-এর বইয়ের দৌলতে এ সব কথাই আমার জানা। সেবেকের পুরোহিতের মমির দিকে দ্রুত একবার চোখ বোলালাম কথাগুলো মনে পড়তে।
দেখলাম মমির গা থেকে কাপড় খুলে ফেলা হয়েছে, শুয়ে আছে একটা গ্লাস প্যানেলের নিচে।
তুমি তো গল্পটা জানোই, আমার চোখের ভাষা পড়তে পেরেছে ভ্যানিং। হপ্তা খানেক হলো মমিটা আছে আমার কাছে; রাসায়নিকভাবে এটাকে পরীক্ষা করা হয়েছে। অবশ্য এ ধন্যবাদ উইলড্যানের প্রাপ্য। পরীক্ষা করতে গিয়ে এই জিনিসটা মমির বুকের ওপর পাই আমি।
একটা জেড পাথরের কবচের দিকে ইঙ্গিত করল ভ্যানিং, কুমির আকৃতির কবচ, গায়ে দুর্বোধ্য হরফে কি যেন লেখা।
কি এটা? জানতে চাইলাম আমি।
পুরোহিতবাদের গোপন কোড। ডি মারিগনির ধারণা এটা নাকাল ভাষা। যার অনুবাদ করলে দাঁড়ায়-প্রিনের গল্পের সেই অভিশাপের মত-কবর লুঠকারীদের ওপর অভিশাপ। সেবেক নিজের হাতে তাদের শাস্তি দেবে এসব কথা। অনেক অশ্লীল ভাষা।
বাক্যবাগীশ ভ্যানিংকে জোর করে কথাগুলো বলানো হলো। ড. ডেলভিন খামোকা খক খক করে কাশতে শুরু করলেন; রয়েসকে আবার তার বেল্ট মোচড়ানো রোগে পেয়ে বসল; ডি মারিগনি ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থাকল। বামন প্রফেসর উইলড্যান এগিয়ে এলেন আমাদের দিকে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন মমিটার দিকে, যেন মণিহীন কোটরের ভেতর থেকে সব রহস্যের সমাধান পেতে চাইছেন।
আমার ধারণার কথা ওকে জানিয়ে দাও, ভ্যানিং, মৃদু স্বরে বললেন তিনি।
উইলড্যান এখানে কিছু তথ্যানুসন্ধান করেছেন। কর্তৃপক্ষকে ফাঁকি দিয়ে মমিটা এখানে নিয়ে আসতে ওঁকে প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়েছে। এটার সন্ধান তিনি কোথায় পেয়েছেন তাও বলেছেন। সে বড় রোমহর্ষক কাহিনী। দেশে ফেরার সময় ক্যারাভানের নয়টা ছেলে মারা যায়, ধারণা করা হয় দূষিত পানি তাদের মৃত্যুর কারণ। একমাত্র প্রফেসরই জীবিত ফেরার সৌভাগ্য লাভ করেন।