[বিদেশী কাহিনী অবলম্বনে]
বানরের মগজ
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাংলো থেকে বের হতেই গায়ে আগুনের হল্কা অনুভব করল রিচার্ড ক্লার্ক। সকাল এখন, কিন্তু মাত্র একশো গজের মত রাস্তা হেঁটেছে সে, সুতি শার্টটা ঘামে ভিজে সেঁটে গেল পিঠের সাথে। কপাল বেয়ে ফোটায় ফোটায় ঘাম ঝরছে, ভুরু ভিজিয়ে চোখে ঢুকছে। চোখ মিটমিট করছে ও, ডান হাতের চেটো দিয়ে একটু পর পর ভুরু থেকে মুছে ফেলছে ঘাম। বন্দরের দিকে মুখ তুলে চাইল ক্লার্ক। সিঙ্গাপুর জেটিতে ডজনখানেক সমুদ্রগামী জাহাজ নোঙর করা, নারকেলের শুকনো শাঁস আর রাবার লোডের অপেক্ষায় আছে। কাজটা শেষ হলে আবার বেরিয়ে পড়বে খোলা সাগরে।
এখানে আবহাওয়ার কোন পরিবর্তন নেই। জানুয়ারি চলছে অথচ গরমটা জুন বা সেপ্টেম্বর মাসের মতই। মাসের পর মাস, দিনে বা রাতে তাপমাত্রা সব সময়। নব্বই ডিগ্রি ফারেনহাইটে স্থির হয়ে থাকছে। বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ খুব বেশি। এমনকি মৌসুমী বৃষ্টিতেও গা পোড়ানো গরম কমছে না।
তবে রিচার্ড ক্লার্ক এ ধরনের আবহাওয়ায় নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছে অনেক আগেই! গত ছবছরে এই দ্বীপ এবং তার বাসিন্দাদের হালহকিকত ভালই চেনা হয়ে গেছে তার। বরং বলা যায় এদের জীবনযাত্রার সাথে এতই অভ্যস্ত ক্লার্ক যে অন্য কোথাও গেলে সে হয়তো স্বস্তিই পাবে না। ককেশিয়ান এবং পূর্ব দেশীয় জনগোষ্ঠীর অনেকের সাথেই ওর হার্দিক সম্পর্ক। স্থানীয়দের সাথে সে মিশে যেতে পারে বন্ধুর মতই। আফিম সেবী, ক্ষয়াটে চেহারার চাইনিজ ধোপা বা আবলুস কালো ভারতীয় সুদখোর ব্যবসায়ী কিংবা সোনার দাঁত বাঁধানো মাড়োয়ারী শেঠ, সবাই তাকে চেনে, শ্রদ্ধা ও সম্মানের চোখে দেখে। ক্লার্কও ওদের ধর্মীয় বিশ্বাস, প্রথাগত আচার-অনুষ্ঠানগুলোর প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শনে কার্পণ্য করে না। ওদেরকে সে-ও বন্ধু হিসেবেই দেখে। ক্লার্কের ইউরোপীয় বন্ধু-বান্ধবদের অনেকে এমন মন্তব্যও করেছে, ক্লার্ক আসলে নিজস্ব সংস্কৃতি বিসর্জন দিয়ে ক্রমশ প্রাচ্যমুখী হয়ে উঠছে। তবে ক্লার্ক বিশ্বাস করে, প্রাচ্যের সংস্কৃতিকে পুরোপুরি ধারণ করতে হলে আরও অনেক কিছু জানতে হবে তাকে, শেখার এখনও বাকি আছে অনেক কিছুই। স্থানীয়দের সংস্কৃতি বা ধর্মবিশ্বাসের প্রতি তার আগ্রহ এত প্রবল যে ক্লার্ক ইংল্যান্ডে, নিজের বাড়ি ঘরের কথা প্রায় ভুলে যেতে বসেছে।
হলদে রঙের একটা মার্সিডিজ ট্যাক্সি সগর্জনে ওর পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিল, হাত তুলে তাকে ডাকল রিচার্ড ক্লার্ক। প্রায় সাথে সাথে ব্রেক কষল ড্রাইভার, টায়ারের সঙ্গে রাস্তার পিসে তীব্র ঘর্ষণে বিকট আওয়াজ উঠল, লাল ধুলোর মেঘ উড়িয়ে দাড়িয়ে পড়ল ট্যাক্সি ওর কাছ থেকে হাত বিশেক দূরে। গাড়ির জানালা দিয়ে হলদে রঙের একটা মুখ উঁকি দিল, মুচকি হাসছে।
ট্যাক্সি, জন?
পা বাড়াল ক্লার্ক, উঠে বসল পেছনের সিট, ড্রাইভার বিপজ্জনকভাবে স্পীড বাড়াল, দড়াম করে সিটের সাথে বাড়ি খেল ও, পঙ্খীরাজের গতিতে ছুটছে ট্যাক্সি। রাগ করল না ক্লার্ক। ট্যাক্সিঅলাদের এমন আচরণ গা সওয়া হয়ে গেছে।
কোনদিকে, জন? জিজ্ঞেস করল ড্রাইভার। তার কাছে সবাই জন।
পায়া লেবার এয়ারপোর্ট।
পাঁচ ডলার-কেমন? তাকাল সে ক্লার্কের দিকে, মুখে চওড়া হাসি ফুটে উঠেছে। প্রত্যুত্তরে ক্লার্কও হাসল।
ফাজলামো হচ্ছে, না? তুমি কি আমাকে বোকা ট্যুরিস্ট ঠাউরেছ? তিন উলার দেব, এক পয়সাও বেশি নয়।
ঠিক আছে, জন-সাড়ে তিন ডলার।
বললাম তো, তিন ডলারের এক পয়সাও বেশি নয়।
ঠিক আছে, জন-আপনার কথাই রইল। এখনও হাসছে ড্রাইভার, লোক চিনতে ভুল করেনি সে।
কোলিয়ার জেটি পার হয়ে গেল ওরা, দ্বীপের দূর প্রান্তের ব্যস্ত চায়না টাউনকেও পাশ কাটাল। এয়ারপোর্টে পৌঁছে ক্লার্ক ড্রাইভারকে তিন ডলার ছাড়া আরও পঞ্চাশ সেন্ট অতিরিক্ত বকশিশ দিল। তরুণ চাইনিজ ড্রাইভার খুশিতে হাত নেড়ে ওকে বিদায় জানাল, গুনগুন করতে করতে আগের চেয়েও বেশি স্পীডে গাড়ি ছোটাল। বার-এ ঢুকে ব্রান্ডির অর্ডার দিল ক্লার্ক, গ্লাসটা নিয়ে চলে এল অবজারভেশন ব্যালকনিতে, ওর মক্কেলের আগমনের অপেক্ষার প্রহর গুণতে হবে।
সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে ওয়েন হ্যারিসন আর আধ ঘণ্টার মধ্যে চলে আসবে। ক্লার্ক তার সাথে হ্যান্ডশেক করবে, নিরর্থক শুভেচ্ছা বিনিময় হবে, তার পরের তিনদিন ওর কাজ হবে আমেরিকানটাকে সিঙ্গাপুর ঘুরিয়ে দেখানো। এজন্য ক্লার্ক তিনশো ডলার পাবে। টাকার অঙ্কটাকে মোটেই মন্দ বলা যাবে না। কাজটা তেমন কঠিন নয় অথচ পারিশ্রমিক ভাল। এ ধরনের কাজ করে আরাম পায় ক্লার্ক। এ পর্যন্ত মক্কেল হিসেবে যত টুরিস্ট ক্লার্কের কাছে এসেছে, এদেরকে হ্যান্ডল করতে কখনও তেমন বেগ পেতে হয়নি তাকে। বিশেষ করে আমেরিকানরা তো ইংরেজি জানা গাইড পেলে বর্তে যায়, থাক গাইডের ইংরেজি উচ্চারণে ভিনদেশী টান। এসব টুরিস্টদের আসলে মনে মনে করুণাই করে ক্লার্ক। এদেরকে তার মনে হয় মাথা মোটা, যাদের কাজ সারাক্ষণ ক্যামেরায় হাবিজাবি ছবি তুলে রাখা, চোখের সামনে যা পড়ে তা-ই দেখে বিস্ময়ে হাঁ হয়ে যাওয়া। ক্লার্ক দেখেছে এরা অত্যন্ত স্বার্থপর স্বভাবের হয় গরীব মানুষদের প্রতি বিন্দুমাত্র মমত্ববোধ নেই, পাশ্চাত্য এবং পুবের মাঝে সাংস্কৃতিক বন্ধনের প্রতিও এতটুকু আগ্রহ নেই। সবকিছুর প্রতি উন্নসিক একটা ভাব, নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখার চেষ্টা। এদের কথা ভাবতে ভাবতে উজিত হয়ে ব্যালকনির রেলিং শক্ত মুঠোয় চেপে ধরেছিল ক্লার্ক, খেয়াল হতে ছেড়ে দিল। পাশ্চাত্যে জন্ম নিলেও মন-মানসিকতায় নিজেকে প্রাচ্যের ভাবধারায় গড়ে তুলছে বলেই হয়তো আমেরিকানদের প্রতি একটা বিতৃষ্ণা জন্ম নিয়েছে তার মধ্যে। সে নিচে, এয়ার ফিল্ডের দিকে তাকাল। রুপোর মত চকচকে বিশাল এয়ারলাইনারটা স্থির হয়ে থাকা পাম গাছগুলোর মাথায় চক্কর দিচ্ছে। এসে গেছে তার মক্কেলের উড়ুক্কু বাহন।