হ্যাঁ, বাবা, নাক চেপে বললেন মিসেস হাসান। তোমাকে ধন্যবাদ।
পরবর্তী দুটো দিন তিনি মালাটা গলায় পরে থাকতে বাধ্য হলেন। মাছের চোখ দৃটে। পচেগলে যাবার পরে মুক্ত হলেন।
ওই ঘটনার পর থেকে চোখ দেখার নেশায় পেয়ে বসল হাসিবকে। সে আয়নার সামনে স্থির হয়ে দেখে নিজের চোখ; বাবা-মার চোখের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে; তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ করে বাগানের পাখিদের চোখ, প্রতিবেশীর বিড়ালটার চোখ, মাঠে চরে বেড়ানো গরুর চোখ; নতুন কাউকে দেখলে তার। চোখের দিকেও নির্নিমেষ চেয়ে থাকে সে। মা তাকে শহরের দোকানে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে শো-কেসে রাখা প্লাস্টিকের মাছের চোখের দিকে হা করে তাকিয়ে রইল হাসিব। ফেরার পথে গুনগুন করতে লাগল, ধুন্দল চোখ, ধুন্দল চোখ।
যত বড় হলে হাসিব, তার ক্রোধ এবং রাগের মাত্রা ততই বৃদ্ধি পেল। বাবা-মা ভয় পেয়ে গেলেন। আবার ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন ওকে। এখন রেগে গেলে আক্ষরিক অর্থেই দানব হয়ে ওঠে হাসিব। বয়স বাড়ার সাথে সাথে তার শরীরের অপুষ্টতা দূর না হলেও, পা-টা এখনও খুঁড়িয়ে চললেও, সে যখন রেগে ওঠে, হাসিবের বাবাও ওকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। তারা সবসময় আতঙ্কে থাকেন হাসিব কখন মস্ত কোন অঘটন ঘটিয়ে বসে।
যেবার ১৬-তে পা দিল হাসিব, তার সীমাহীন অত্যাচার নিয়ে ডাক্তারের কাছে আবার অভিযোগ করলেন হাসান দম্পতি। তারা বললেন, হাসিব এখন আর আমাদেরকেও সহ্য করতে পারছে না। জানি না কেন।
ডাক্তার বললেন, আপনাদের আগেই বলেছিলাম হাসিবকে সাভারে পাঠিয়ে দিতে। শুনলেন না। টঙ্গিতে অ্যাবনরমালদের জন্য একটা প্রাইভেট হাসপাতাল খুলেছে আমার এক বন্ধু। ইচ্ছে করলে ওকে ওখানেও পাঠিয়ে দিতে পারেন। ওখানে হাসিবের মত আরও ছেলে আছে। সুচিকিৎসাই হবে আপনাদের সন্তানের।
হাসিবের বাবা-মা পরস্পরের দিকে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন, মন্তব্য করলেন না কোন। শেষে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলেন টঙ্গির হাসপাতালে পাঠিয়ে দেবেন তারা হাসিবকে। না হলে অবস্থা আরও কত খারাপের দিকে মোড় নেবে বলা যায় না।
কিন্তু হাসিবকে কথাটা বলার পরে সে রুদ্রমূর্তি ধারণ করল। ডজনখানেক কাপ-পিরিচ ভেঙে, মাকে খামচে মুখ থেকে রক্ত বের করে দেয়ার পরে একটু শান্ত হলো। মিসেস হাসান আঁচল দিয়ে রক্ত মুছে অনেক চেষ্টায় কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক রাখলেন। বললেন, ওখানে তুমি অনেক খেলার সাথী পাবে। সবাই তোমার বয়সী।
মি. হাসান উৎসাহ দিলেন, ওটা আসলে একধরনের স্কুল, হাসিব। আর সবাইকেই একটা সময় স্কুলে যেতে হয় জানাই আছে তোমার।
হাসিব স্থির চোখে বাবা-মা-র দিকে তাকিয়ে থাকল। চুপচাপ কিছুক্ষণ কি যেন ভাবল। তারপর প্রশ্ন করল, ওলা (ওরা) আমাকে মালা বানাতে ডেবে (দেবে)?
অবশ্যই দেবে। একসাথে বলে উঠলেন হাসান দম্পতি।
কতগুলো ছেলে ওলা? জিজ্ঞেস করল হাসিব।
এই ধরো, চৌত্রিশ জন, জবাব দিলেন মিসেস হাসান।
সবাল (সবার চোখ আসে (আছে)? জানতে চাইল হাসিব।
অবশ্যই আছে।
এবার হাসি ফুটল হাসিবের মুখে। ওর হাসিমুখ দেখে মি. এবং মিসেস হাসানও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন।
হাসিবকে টঙ্গির মানসিক হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া হলো। টানা দুবছর সে ওখানেই থাকল। এর মাঝে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটার কথা শোনা গেল না। হাসিবের অনুপস্থিতিতে, হাসান দম্পতি অনুভব করলেন, তাঁরা নিজেদেরকে অনেকটা ভারমুক্ত ভাবতে পারছেন। এমন ভাবনা অবশ্য তাদের মাঝে খানিকটা অপরাধবোধ জাগিয়ে তুলল। কিন্তু, বছর দুই পরে, হপ্তাখানেকের ছুটি পেয়ে হাসিব বাড়ি ফিরছে জেনে, বুক ঢিবঢিব শুরু হয়ে গেল মিসেস হাসানের। অজানা আশঙ্কায় সিঁটিয়ে থাকলেন তিনি। তাকে সিডেটিভ পর্যন্ত খেতে হলো। আর মি. হাসানের সিগারেটের নেশাটা হঠাৎ বেড়ে গেল।
ছুটি পেয়ে হাসিব বাড়ি ফিরল নতুন নীল সুট আর সবুজ স্যাটিনের টাই পরে। প্রকাণ্ড মাথার এলোমেলো চুলগুলো এখন সুবিন্যস্তভাবে আঁচড়ানো। তার উচ্চারণেরও আগের চেয়ে উন্নতি হয়েছে। সে বাড়ি এসেই রুই মাছের মুড়ো খেতে চাইল। বাবাকে দেখে এবং নিজের পুরানো বাড়িতে ফিরে আসতে পেরে তাকে বেশ খুশি লাগছে।
হাসিবের ঘরটা মা আগেই ঝেডেপুঁছে রেখেছিলেন। তবে পুঁতির মালা এবং ব্রেসলেটগুলো সরাতে সাহস পাননি। হাসিব সবগুলো মালা গলায় জড়িয়ে খেতে বসল। মাকে এবার আর একটাও মালা দিল না।
খাওয়ার সময় প্রায় কথাই বলল না হাসিব। বাবা-মা অবাকই হলেন ডাইনিং টেবিল থেকে হাসিবকে সোজা ঘুমাতে যেতে দেখে। কোন কারণে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে আছে হাসিব, ভাবলেন ওঁরা। তবে ছেলেকে ঘাটাতে সাহস করলেন না।
সেই রাতে, সবাই ঘুমে অচেতন, এমন সময় বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল হাসিব। ঢুকল রান্নাঘরে। মাংস কাটার ধারাল চাপাতিটা নিয়ে মা-বাবার ঘরে ঢুকল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই চাপাতির কোপে নৃশংসভাবে খুন হয়ে গেলেন দুজনেই। রক্তমাখা অস্ত্রটা নিয়ে প্রতিবেশী বৃড়ির বাড়িতে হামলা চালাল হাসিব এরপর। এককোপে বুড়ির কল্লা নামিয়ে দিল। বুড়ির বিড়ালটারও একই দশা করল সে।
পরদিন সকালে পুলিশ এসে দেখল হাসিব তার ঘরের মেঝেতে বসে আছে শান্ত ভঙ্গিতে, মালা গাঁথছে তিনজন মৃত মানুষ আর বিড়ালটার চোখ দিয়ে।