[মূল: ভিডা ডেরী’র ‘ডেথ টেকস ভেনজেন্স’]
চোখ
ওয়াহিদ হাসিব আর দশটা সাধারণ ছেলের মত নয়। তার মাথাটা বিরাট, শরীরটা ছোট এবং একটা পা খোড়া। কথা বলে সে জড়িয়ে, আধো গলায়, উচ্চারণ অস্পষ্ট। বিশ্রী চেহারার মতই তার ব্যবহার বাজে। সাংঘাতিক বদরাগী, নিষ্ঠুর, অন্যদের নির্যাতন করে মজা পায়। তাকে কেউ ভালবাসে না।
ওয়াহিদ হাসিবের বাবা-মা অনেক চেষ্টা করেছেন তার সাথে মানিয়ে চলতে, কিন্তু কিছুতেই পেরে উঠছেন না। ডাক্তার ওকে সাভারে, প্রতিবন্ধীদের হাসপাতালে পাঠিয়ে দিতে বলেছিলেন। কিন্তু রাজি হননি হাসিবের বাবা-মা। একমাত্র সন্তান, হোক সে অ্যাবনরমাল, তাকে চোখের আড়াল করলে ওঁরা বাঁচবেন কি নিয়ে? আর হাসিব খুবই ছোট। সে-ও তার বাবা-মাকে ছাড়া থাকতে পারবে না।
ওয়াহিদ হাসিবের সাথে পাড়ার ছেলেরা মেশে না। ভীতু ছেলেগুলো ভয়ে দশ হাত দূরে সরে থাকে সবৃ সময়। তবে দুষ্টুগুলো দূর থেকে ওকে ভেংচি কাটে। তখন বীভৎস চেহারাটাকে আরও বিকট করে চিৎকার করতে থাকে হাসিব। হাতের কাছে যা পায় তাই ছুঁড়ে মারে। দুষ্ট ছেলেগুলোর সাথে দৌড়ে পারবে না বলে নিষ্ফল আক্রোশে ফুঁসতে থাকে। দুষ্টু ছেলেগুলো এতে আরও মজা পায়। নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে তারা হাসিবকে আরও ভেংচাতে থাকে। অবস্থা যখন অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেল, হাসিবের বাবা-মা বাড়ি বদল করে শহরতলির এক নির্জন প্রান্তে চলে এলেন। এখানে মাত্র একজন প্রতিবেশী পেলেন তারা। এক বুড়ি, যার ছেলে বিদেশে থাকে। বুড়ির সময় কাটে নিজের পোষা বিড়ালটাকে নিয়ে! আর কাঁথা সেলাই করে।
নতুন বাড়িতে এসে হাসিবের নতুন একটা শখের কথা জানা গেল। সে সেলাই-ফোড়াইর দিকে ঝুঁকে পড়ল। হতে পারে বুড়িকে প্রায় সারাদিন কাথা সেলাই (বুড়ির ঘরে নাতনী আসবে) করতে দেখে এই শিল্পকর্মটির প্রতি তার। আকর্ষণ জন্মেছে। তবে বুড়িও হাসিবকে পছন্দ করে না। বুড়ির চোখে হাসিব বদ্ধ পাগল। আর পাগলরা কখন কি করে বসে তার ঠিক আছে? অবশ্য হাসিব বুড়ির বাড়িতে কখনও যায়নি, তার বাবা-মা-ই যেতে দেয়নি। হাসিবের বাইরে যাবার প্রয়োজনও হয় না। মা তাকে নানা রঙের পুঁতি কিনে দিয়েছিলেন। দেখা গেল সেই পুঁতি দিয়ে মহা উৎসাহে মালা বানাতে বসে গেছে হাসিব। মানসিক দিক থেকে সম্পূর্ণ অপরিণত হলেও হাসিবের হাতের কাজ চমকার। সে সুঁই-সুতো দিয়ে দারুণ মালা আর ব্রেসলেট তৈরি করতে লাগল আর এগুলো গলায় এবং হাতে পরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ চোখে দেখল নিজেকে। বোঝাই যায় কাজটাতে সে অপরিসীম আনন্দ খুঁজে পেয়েছে।
হাসিবের উদ্ভট আনন্দের আরেকটি উৎস হলো মশা বা মাছি ধরে তাদের পাখা ছিঁড়ে ফেলা এবং সুযোগ পেলেই বুড়ির বিড়ালটার লেজে আগুন দেয়া। মাঝে মাঝে, অকারণে মনে খুব ঘূর্তি থাকলে হাসিব তার মাকে নিজের তৈরি পুঁতির মালা উপহার দেয়। মিসেস হাসান যতক্ষণ ছেলের সামনে থাকেন, মালা এবং ব্রেসলেট পরে থাকতে বাধ্য হন। না পরলে ভয়ঙ্কর রেগে যায় হাসিব, মনে হয় ফিট হয়ে যাবে।
এমন অস্বাভাবিক সন্তান নিয়ে জীবন যাপন, যত দিন যাচ্ছিল, সত্যি কঠিন হয়ে উঠছিল হাসান দম্পতির জন্য।
যতক্ষণ নিজের কাজের মাঝে ডুবে থাকে হাসিব, বিশ্বসংসার ভুলে যায় সে। কাজ বলতে মালা তৈরি ছাড়া বাড়ির লাগোয়া ছোট্ট বাগানে ফডিং আর চড়ুইয়ের পেছনে ছোটাছুটি। এদের ধরতে পারলেই সে ডানা ভেঙে দেয়, পাখা ছিঁড়ে ফেলে, মুচড়ে দেয় ঘাড়। তখন চোখ চকচক করতে থাকে হাসিবের।
ওয়াহিদ হাসিবের নবম জন্মদিনে, রাতে ভূরিভোজের সময় তার পাতে তুলে দেয়া হলো রুই মাছের আস্ত একটা মুড়ো। এতদিন তাকে মাছের টুকরো দেয়া হয়েছে, কাটা বেছে দিয়েছেন মা। এবার রুইয়ের মাথাটা ওর প্লেটে তুলে দিয়ে মিসেস হাসান সস্নেহে বললেন, খাও, বাবা। পুরোটাই তোমার। দেখি কেমন কাটা বাছতে পারো। হাসিবের বাবাও ওকে উৎসাহ দিলেন।
জীবনে এই প্রথম এত বড় একটা মাছের মাথা খাচ্ছে হাসিব! সে ধীরেসুস্থে কাটা বাছতে শুরু করল। মুড়োটা পুরো খেতে পারল না। পারার কথাও নয়, এটো ছড়িয়ে সে পুরো টেবিলটাকে নোংরা করে দিল। শত হলেও আজ ওর জন্মদিন। তাই বাবা-মা দৃশ্যটা দেখেও না দেখার ভান করলেন। পায়েস খাওয়ার সময় সারা মুখ ভরিয়ে ফেলল সে। তবু কিছু বললেন না ওঁরা। জানেন, কিছু বলতে গেলে হিতে বিপরীত হবে। প্লেট, গ্লাস ভেঙে কিছু রাখবে না হাসিব। তাই ও যখন খাওয়া শেষ করে বেসিনে গেল মুখ ধুতে, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে টেবিল পরিষ্কারে লেগে গেলেন মিসেস হাসান। মি. হাসান ঢুকলেন ড্রইংরুমে, টিভি দেখবেন।
একটু পরে খাবার ঘরে আবার এল হাসিব। তখনও টেবিল পুরোপুরি পরিষ্কার করে উঠতে পারেননি মিসেস হাসান। হাসিব অস্থির, চঞ্চল চোখে কি যেন খুঁজল এঁটো কাটার মধ্যে। এমন সময় টেলিফোন বেজে উঠলে মিসেস হাসান ঘরে গেলেন ফোন ধরতে। কথা বলা শেষ করে এসে দেখলেন চলে গেছে হাসিব।
সে রাতে ঘুমুতে যাবার আগে হাসিব তার মাকে আরেকটা পুঁতির মালা উপহার দিল। মিসেস হাসান হাসিমুখে মালাটা পরলেন। কিন্তু আঁশটে একটা গন্ধ পেতে মালাটার দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠলেন। রুই মাছের স্নান বিবর্ণ চোখ দিয়ে এবার মালা গেঁথেছে হাসিব। মিসেস হাসানের গা গুলিয়ে উঠল, পেট ঠেলে বমি এল! অনেক কষ্টে নিজেকে স্বাভাবিক রাখলেন। কারণ তার ছেলে মহা উৎসাহে ন্দিল (সুন্দর। চোখ! থুন্দিল চোখ! বলে চেঁচাতে শুরু করেছে। এখন মালা খুলতে গেলে হাসিব রক্তারক্তি কাণ্ড বাধিয়ে বসবে। হাসিব লাফাতে লাফাতে বলতে লাগল, তোমাকে খুব গুন্দল লাগছে, মা! খুব গুল মালা, না?