হঠাৎ মেরী ওপর থেকে ওর নাম ধরে ডাকল। পৈশাচিক মূর্তিটা অদৃশ্য হয়ে গেল সাথে সাথে। ভয়ানক আতঙ্কে স্তব্ধ আর্থার টলতে টলতে উঠে এল ওপরে। মেরী ওর চেহারা দেখে ভয়ে চিৎকার করে উঠল। আর্থারের মুখ কাগজের মত সাদা। শরীর কাঁপছে থরথর করে।
আর্থার স্পষ্ট বুঝতে পারছে এডিথের প্রেতাত্মার কবল থেকে মুক্তির একটাই পথ-এই মুহূর্তে মেরীর সান্নিধ্য ত্যাগ করা। কিন্তু মেরী ওকে ছাড়তেই চাইছে না। বরং ওকে যত্ন করে আগুনের সামনে বসাল, গরম দুধ আর হুইস্কি খাইয়ে দিল মমতাভরে। আর্থার ঢক ঢক করে পানীয় দুটো গিলল। মেরী বোতলে গরম পানি ভরতে ভরতে বলল, আসলে খুব বেশি ঠাণ্ডা লেগেই তোমার এই অবস্থা হয়েছে, আর্থার ডিয়ার। কাল তোমার সারাদিন বিশ্রাম নেয়া উচিত। দোকানের কাজকাম আমরা দুজনেই দিব্যি চালিয়ে নিতে পারব। আমি তোমাকে কালকেও দেখতে আসব।
মেরীর কথা শুনে আর্থারের টেনশন বাড়ল আরেক দফা। এডিথ এই ব্যাপারটাকে মেনে নেবে না কিছুতেই। মেরীকে যদি সে ত্যাগ না করে সেই পিশাচিনী ফিরে আসবে আবার। মেরীর সাথে সম্পর্ক চুকিয়েই ফেলতে হবে ওকে। এছাড়া কোনও পথ নেই। কিন্তু নিজেকে এত ক্লান্ত আর বিধ্বস্ত লাগল যে মেরীকে চলে যাওয়ার কথা বলার শক্তিও পেল না।
মেরী অনেকক্ষণ বকবক করে অবশেষে বিদায় হলো। আর্থার বিছানায় শুয়ে চেষ্টা করল ঘুমাতে। কিন্তু দুঃস্বপ্ন তাড়া করল ওকে ঘুমের মধ্যে। স্বপ্নে দেখল ওর মৃত স্ত্রী আবার ফিরে এসেছে সেই ভয়ঙ্কর ঠাণ্ডা আর পৈশাচিক রূপ নিয়ে। তার হাডিউসার হাতদুটো বুকে রেখে চাপ দিচ্ছে, ক্রমশ বাড়ছে সেই চাপ। শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে আর্থারের। চেষ্টা করছে ঘুম থেকে জেগে উঠতে। কিন্তু পারছে না। সেই ভয়ঙ্কর হাতের দানবীয় চাপ আরও বেড়ে চলছে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে আর্থারের। তীব্র যন্ত্রণায় গুঙিয়ে উঠল সে। তারপরই ঘুম ভেঙে গেল।
পরদিন দোকানে ঢুকেই মেরীকে সোজা জবাব দিয়ে দিল আর্থার। তোমার ওই নাট্যচর্চার ব্যাপারটা আমাকে খুব বিরক্ত করে তুলেছে, মেরী। আমি এই যন্ত্রণার হাত থেকে মুক্তি চাই। চাই আরও স্বাধীনতা। আমার এখন পুরুষ বন্ধুদের সঙ্গ দরকার। তোমার সঙ্গ আমার কাছে ইদানীং স্রেফ ন্যাকামি মনে হচ্ছে। আমি এখন থেকে বন্ধুদের সাথে মদ খেয়ে মাতাল হব, গল্পগুজবে মেতে উঠব। তোমার সাথে নাটক করে এই ক্ষুদ্র জীবনটাকে আর একঘেয়ে করে তুলতে চাই না। জীবনটা আমি ইচ্ছেমত উপভোগ করব। তোমার যদি এখন ইচ্ছে হয় আমার দোকানে থাকতে পারো। কিন্তু আমাদের সম্পর্ক এখন থেকে শুধু ব্যবসায়িক সম্পর্কের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। অন্য কিছু নয়। আর্থার এক নিঃশ্বাসে গড়গড় করে কথাগুলো বলে গেল। অপমানে, দুঃখে মেরীর চোখে জল এল। দৃশ্যটা দেখে আর্থারের নিজের কাছেই খুব খারাপ লাগল। কিন্তু এছাড়া ওর আর কিইবা করার ছিল? মেরীর সাথে এভাবে খারাপ ব্যবহার না করলে সে তাকে ত্যাগ করবে না, বাধ্য হয়ে এই কর্কশ পথটা বেছে নিতে হয়েছে ওকে। কারণ এখন এডিথের পালা। এডিথ জিততে শুরু করেছে। মৃত্যুর আগের সেই হুমকি এভাবে সে কাজে লাগাবে স্বপ্নেও ভাবেনি আর্থার। এই বিভীষিকা থেকে বুঝি এ জীবনে রক্ষা পাবে না সে।
মেরীর সাথে খারাপ ব্যবহার করার পর থেকে বিবেকের দংশনে জ্বলছে আর্থার। কিছুতেই নিজেকে ক্ষমা করতে পারছে না। মেরী এদিকে তার ব্যবহারে ভয়ানক মর্মাহত হয়ে চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। ওর জায়গায় গিলবার্ট নামে এক লোক এসেছে। কিন্তু মেরীর শূন্যস্থান পূরণ হবার নয়। বসের মন জয় করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হলো সে। আর আর্থার মেরীকে ভুলে থাকার জন্যই যেন আবার মদ খেতে শুরু করল। ব্যবসা সম্পর্কে দারুণ উদসীন হয়ে উঠল। আবার আগের মত ব্যবসার বারোটা বাজতে শুরু করল। কিন্তু অর্থারের সেদিকে কোনও নজর নেই। এডিথের ভূত এখন আর তাকে তাড়া করে ফেরে না বটে, কিন্তু অতিরিক্ত মদ্যপান আর অনিয়মিত খাওয়া দাওয়ার ফলে তার স্বাস্থ্য ভেঙে পড়তে শুরু করল দ্রুত।
এক রোববার সকালে ঘুম ভাঙার পর আর্থারের ফেলে আসা সাসেক্স টাউনের জন্য মন খুব কেমন করতে লাগল। কতদিন সে নিজের বাড়িতে যায় না। খুব ব্যাকুল হয়ে উঠল সে বাড়ি যাওয়ার জন্য। সিদ্ধান্ত নিল আজকেই যাবে।
সন্ধ্যার সময় পৌছুল সে বাড়িতে। অত্যন্ত রোগা আর্থারকে চিনতে পারছিল না কেউ। বুকের মধ্যে দারুণ ব্যথা চেপে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াল সে। ঘুরতে ঘুরতে চার্চে কখন চলে এসেছে নিজেও জানে না।
একটি মাত্র আলো মিটমিট করে জ্বলছে ভেতরে। একটি মেয়ে বসা ওখানে। সে ঘুরল। আর্থার তাকে দেখে চমকে উঠল। এ যে এডিথ! কিন্তু এ সেই তরুণী এডিথ, যার সাথে আর্থারের বিশ বছর আগে এই জায়গাতেই প্রথম দেখা হয়েছিল। এডিথ ওকে দেখে মধুর হাসল। হাতছানি দিয়ে ডাকল। কি যে হলো আর্থারের, মন্ত্রমুগ্ধের মত এগিয়ে গেল এডিথের দিকে। এডিথ হাঁটতে শুরু করল হালকা পায়ে। সম্মোহিতের মত তাকে অনুসরণ করে চলল আর্থার।
হাঁটতে হাঁটতে ভেজা একটা কবরের পাশে এসে দাঁড়াল এডিথ। হাত তুলে আহ্বান করল আর্থারকে। তীব্র তুষ্ণা বুকে নিয়ে সেই আহ্বানে সাড়া দিল আর্থার। শিশু যেন মায়ের কোলে আশ্রয় নিচ্ছে এইভাবে সে সেঁধিয়ে গেল এডিথের বুকের ভেতর। এডিথ কোমল বাহ দিয়ে ওকে পেঁচিয়ে ধরল। এবং তখুনি ওর চেহারার পরিবর্তন শুরু হলো। আস্তে আস্তে তরুণী এডিথের লাবণ্য মুছে গিয়ে চেহারাটা বীভৎস হয়ে উঠল। সেই আগের পৈশাচিক চেহারায় রূপান্তরিত হলো এডিথ। আপেল রাঙা গালের মাংস খসে গিয়ে সাদা হাড় বেরিয়ে পড়ল, মায়াবী চোখ দুটো গলে গিয়ে মণিহীন দুটো গর্ত ধক ধক করে উঠল। মুখ থেকে বমি ওঠা পচা গন্ধটা ভকভক করে বেরিয়ে আসছে। আর্থারের হৃৎপিণ্ড খাচার সাথে বাড়ি খেতে শুরু করল। মনে হচ্ছে ওর গলা যেন চেপে বসছে, শ্বাস নিতে পারছে না। প্রাণপণে মনে করতে চাইল এটাও একটা দুঃস্বপ্ন। কিন্তু এটা কোনও দুঃস্বপ্ন নয়। আর্থার স্পষ্ট অনুভব করছে মুখের ওপর বড়বড় ফোঁটায় বৃষ্টি পড়ছে। হাড্ডিসার হাতদুটো যেন অজগরের মরণ পার্ক শ্বাসরোধ করে ফেলছে ওর। দুনিয়া আঁধার হয়ে আসছে দ্রুত। টের পাচ্ছে এডিথ ওকে নিয়ে কবরের মধ্যে ঢুকছে..মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে আর্থার আবছাভাবে দেখতে পেল এডিথ মাংসহীন মাড়ি বের করে হাসছে। বিজয়ের উৎকট উল্লাস সেই হাসিতে। অবশেষে জয়ী হতে চলেছে এডিথের প্রেতাত্মা। প্রতিশোধ নিচ্ছে সে। ভয়ঙ্কর প্রতিশোধ