আর্থার খুব শিগগিরই আবিষ্কার করল নাট্যকলা সম্বন্ধে তার তন্বী সহকারিণীর দারুণ দুর্বলতা রয়েছে। এই সুযোগটা কাজে লাগাল সে। তার বন্ধু মহল, যারা নাট্যচর্চা করে, তাদের ওখানে নিয়ে যেতে শুরু করল সে মেরীকে। নাট্যচর্চার ওপর বই কিনে দিল ওকে, পড়ে শোনাল। এমনকি নিজে প্রমোটরের ভূমিকাও পালন করতে লাগল। মেরীকে সে অভিনয় করার জন্য পোশাক-আশাক কিনে দিতে দ্বিধা করল না। মেরী স্বভাবতই তার চাকরিদাতার প্রতি হৃদয়ের অন্তঃস্তল থেকে কৃতজ্ঞতা অনুভব করল। দেখতে দেখতে ওদের মধ্যে বন্ধুত্বের চেয়েও নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠল। তরুণী মেরী বুঝতে পারল বিপত্নীক এই লোকটিকে কখন জানি সে অজান্তে ভালবেসে ফেলেছে। আর আর্থার মেরীর স্নিগ্ধ সাহচর্যে মদ খাওয়া। ছেড়ে দিল আস্তে আস্তে। আবার জীবনটা আগের মত উপভোগ্য হয়ে উঠল তার কাছে।
এক রাতে আর্থারদের নাট্যদল লাল গোলায় খুন নাটকের রিহার্সাল দিচ্ছে। দৃশ্যটা এরকম-মারিয়া নামের মেয়েটিকে তার প্রেমিক খুন করার জন্য লাল গোলায় নিয়ে এসেছে। আজকের রিহার্সালেও আগের মতই প্রমোটরের দায়িত্ব পালন করছে আর্থার। বিশাল হলরুমের গা ছমছমে পরিবেশের জন্য, নাকি দৃশ্যটার ভয়ঙ্করত্নের জন্য, ঠিক বলতে পারবে না আর্থার, কিন্তু উইংসের অন্ধকারে দাঁড়িয়ে প্রমোট করতে করতে এক সেকেন্ডের জন্য বই থেকে মুখ তুলে স্টেজের ম্লান আলোর দিকে তাকাতেই শরীর শিরশির করে উঠল তার। মনে হলো স্টেজে ওর মৃত স্ত্রী সেই পৈশাচিক মূর্তি নিয়ে দাড়িয়ে আছে। সাথে সাথে ওর হাত কাঁপতে লাগল। কাপুনিটা এতই তীব্র যে বইটা ছিটকে পড়ে গেল মাটিতে। মেরী পাশেই দাঁড়ানো ছিল। তাড়াতাড়ি বইটা হাতে তুলে নিল সে।
ভয়ে ভয়ে আর্থার মেরীর দিকে ফিরল। এটা কি সত্যিই মেরী নাকি তার রূপ ধরে স্বয়ং এডিথ আবার এখানে এসেছে ওকে ভয় দেখাতে?
কি হয়েছে, আর্থার? তোমাকে এরকম দেখাচ্ছে কেন? মেরী ফিসফিস করে বলল, মনে হচ্ছে যেন ঠাণ্ডায় জমে গেছ।
আর্থার মেরীর প্রসারিত হাতটা চেপে ধরল দুহাতে। উষ্ণ, নরম হাত। এই হাত কোনও অশরীরীর হতে পারে না। নিজেক্লে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করল এই ভেৰে, নিশ্চয়ই চোখে ভ্রম দেখেছে। পা দুটো কাঁপছিল ওর। কাঁপুনি বন্ধ করার চেষ্টা করতে করতে মেরীকে বলল, সে ঠিকই আছে, চিন্তার কিছু নেই, কিন্তু মন যে কিছুতেই মানে না! মৃত স্ত্রীর আত্মা এই লন্ডনেও তাকে ধাওয়া করে এসেছে এই চিন্তাটা কিছুতেই মন থেকে দূর করতে পারল না আর্থার।
রিহার্সাল শেষ হয়ে গেল। মেরী জিদ ধরল আর্থারের সাথে সেও তার বাড়ি যাবে তাকে পৌঁছে দিতে। যুক্তি দিয়ে বোঝাতে চাইল এই অবস্থায় তার একজন সঙ্গীর প্রয়োজন।
তোমার এখন দুধ আর হুইস্কির একটা গরম ড্রিঙ্ক দরকার, মেরী বলল ওকে, এবং আমি তোমার সাথে গিয়ে দেখতে চাই বিছানায় যাওয়ার আগে তুমি ওটা ঠিকঠিক খেয়েছ।
অন্য সময় হলে আর্থার সহাস্যে মেরীর এই প্রস্তাবে রাজি হত। কিন্তু পরিস্থিতি এখন ভিন্ন। বরং আর্থার এখন মেরীকে কাটাতে পারলেই বাঁচে।
আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, গরম দুধ এবং হুইস্কি দুটোই খাব। তোমাকে আর কষ্ট করে যেতে হবে না, মেরী ডিয়ার। বলেছ এতেই আমি খুশি।
কিন্তু মেরী ওকে একা ছাড়ল না। সঙ্গে এল। দরজা খুলে যখন মেরীকে ভেতরে যেতে বলছে, আর্থার চকিতে একবার ভীত দৃষ্টিতে পেছন ফিরে তাকাল। দোতলায় উঠে এল ওরা। হাফ-ল্যান্ডিংয়ে টিমটিমে বাতি জ্বলছে। আর্থার বান্ধবীকে নিয়ে ওর লিভিংরুমে ঢুকল। দ্রুত হাতে টেবিল ল্যাম্প এবং ম্যান্টলপিসের ওপর রাখা বাতি দুটো জ্বেলে দিল। তড়িঘড়ি করে গ্যাসের চুলোয় আগুন ধরিয়ে দুধের পাত্রটা একটানে বের করল শেলফ থেকে। ওটাতে খানিকটা দুধ ঢেলে বসিয়ে দিল চুলোর ওপর।
মেরী ওর ব্যস্ততা দেখে মনে মনে হাসছিল। কাজ করতে আর্থার এতই ব্যস্ত যে ওকে চুমু খেতে পর্যন্ত ভুলে গেছে। অথচ এটা অস্বাভাবিক একটা ব্যাপার। কারণ এর আগে ওরা যখনই একত্রিত হয়েছে, আর্থার সবার আগে চুম্বন পর্বটি সেরে নিতে ভোলেনি।
আমি কিন্তু তোমার মত ঠাণ্ডা বাধাইনি, ডার্লিং। মদালসা কণ্ঠে বলতে বলতে মেরী আর্থারের হাত দুটো টেনে নিয়ে নিজের কোমরে রাখল। মুখ উঁচু করল। ফাঁক হয়ে গেছে কমলা কোয়ার মত অধর। চুম্বনের প্রত্যাশায় অধীর। আর্থারের এই আমন্ত্রণে সাড়া না দিয়ে উপায় কি? দুজোড়া ঠোঁট মিলেমিশে এক হয়ে গেল, হয়েই। থাকল। হঠাৎ দুধ উপচে পড়ার শব্দ শুনে স্বর্গ থেকে মর্তে ফিরে এল আর্থার। তাড়াতাড়ি বিচ্ছিন্ন হলো মেরীর কোমল আলিঙ্গন থেকে কাপড় দিয়ে চুলোর গায়ে উপচে পড়া দুধ মুছছে, এমন সময় শুন নিচের দরজায় ধড়াম ধড়াম শব্দ হচ্ছে। মেরীও শব্দটা শুনল। নিচে গিয়ে দরজাটা ভাল করে লাগিয়ে এসো, ডার্লিং, তুমি নিশ্চয়ই ওটা লাগাতে ভুলে গেছ। বলল সে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও উঠে দাঁড়াল আর্থার। হঠাৎ অনুভব করল ঘরের ভেতরে যেন একরাশ ঠাণ্ডা হাওয়া ঢুকে গেছে। সেই হাওয়া ওর শরীরটাকেও নাড়া দিয়ে গেল। ওর খুব ভাল করেই মনে আছে ওরা যখন ভেতরে ঢুকেছে তখন দরজাটা বন্ধ করেই এসেছে। কিন্তু মেরীকে মুখ ফুটে বলতে পারল না বাইরের অন্ধকারে যেতে সে ভয় পাচ্ছে। ভয় পাচ্ছে কারণ সে ভাল করেই জানে নিচে গেলে কাকে দেখতে পাবে। যা থাকে কপালে, কিন্তু প্রেমিকার কাছে কাপুরুষ সাজব না ভেবে দৌড়ে নিচে নেমে এল আর্থার। দরজা বন্ধই আছে। কাপা হাতে হুড়কো লাগিয়ে দিল সে এবার। আর তখুনি সেই বিকট পচা গন্ধটা নাকে ভেসে এল। যেন কবর থেকে উঠে এসেছে। প্রচণ্ড ভয়ে কেঁপে উঠল আর্থার, ঘুরল। জানে কাকে দেখতে পাবে। দাড়িয়ে আছে সে। ওর পথ রোধ করে। সবুজ একটা আলো ঠিকরে আসছে তার অন্ধকার চোখের গর্ত থেকে। গালের মাংস পচে খসে পড়েছে। মুখের অর্ধেকটা নেই, বেরিয়ে পড়েছে চোয়াল, বীভৎস ভঙ্গীতে হাসছে সে। ডিড়সার হাত দুটো দিয়ে সে আর্থারের গলা জড়িয়ে ধরল। বাধ্য করল তার চোখহীন অন্ধকার গর্তের দিকে তাকাতে। যেন অভিশাপ দিচ্ছে। তীব্র আতঙ্কে শরীর অবশ হয়ে এল আর্থারের।