সাথে সাথে ভয়ানক নাড়া খেল আর্থার। মনে হলো বরফের মত ঠাণ্ডা, অস্তিত্বহীন একটা জিনিসকে সে জড়িয়ে ধরেছে। ম্যাবেল এই সময় মুখ ঘোরাতে শুরু করল। ভয় কাকে বলে টের পেল আর্থার। তীব্র আতঙ্কে শরীর কেঁপে উঠল। এ কাকে দেখছে সে? এ তো ম্যাবেল নয়, ম্যাবেলের সেই চাদের মত ঢলঢল মুখখানা কোথায়? খড়ির মত সাদা মুখ, নিপ্রাণ কোটরাগত চোখে বিকৃত ভঙ্গী নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে হাসছে তারই মৃতা স্ত্রী এডিথ। ঘৃণা আর ভয়ে আর্তনাদ করে ছিটকে সরে গেল আর্থার।
বীভৎস মূর্তিটা ওর দিকে সাদা হাড়ের একটা আঙুল তুলল, যেন অমঙ্গলের সঙ্কেত দিচ্ছে। পরক্ষণে অদৃশ্য হয়ে গেল সে। সঙ্গে সঙ্গে আর্থারের মনে পড়ল মহাশ্যায় এডিথ ওকে কি হুমকি দিয়েছিল। ভয়ে কাঁপতে কাপতে ব্রিজ লক্ষ্য করে দুটল সে। এক দৌড়ে ব্রিজ পেরিয়ে রাস্তায় নেমে এল। হঠাৎ দেখল ম্যাবেল এগিয়ে আসছে ওর দিকে। কিন্তু একি সত্যিই ম্যাবেল নাকি ম্যাবেলের পোশাকে সেই প্ৰেতিশী? ভায় আর উত্তেজনায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাপতে লাগল আর্থার। ম্যাবেল একেবারে কাছে আসার পর নিশ্চিন্ত হলো, না, এ তার প্রেমিকাই।
খুব অধৈর্য হয়ে পড়েছিলে, তাই না, সোনা? কোমল দুই বাহু দিয়ে আর্থারের ঘাড় জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করল ম্যাবেল।
স্বস্তির বিরাট এক নিঃশ্বাস ফেলল আর্থার। ম্যাবেলের উষ্ণ হাতের স্পর্শ, গা থেকে ভেসে আসা সেই পরিচিত পারফিউমের গন্ধে যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পেল। কিন্তু কাপা হাতে আস্তে করে ম্যাবেলের আলিঙ্গন থেকে নিজেকে মুক্ত করল সে।
কি হয়েছে, আর্থার? কাঁপছ কেন? দেরী হওয়ার জন্য খুব রেগে গেছ বুঝি? নাকি তোমাকে কেউ ভয় টয় দেখিয়েছে? আর্থার নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল। ম্যাবেলকে কড়া এক ধমক লাগাবে ভেবেছিল। চিন্তাটা বাদ দিয়ে যথাসম্ভব শান্ত গলায় জানতে চাইল এত দেরী হলো কেন ওর।
দেরী হওয়ার জন্য আমি খুবই দুঃখিত, ডার্লিং। বলল ম্যাবেল, আমার শাশুড়ী হঠাৎ করেই বিকালে এসে হাজির। এ জন্যই সময়মত আসতে পারিনি। থাকগে, ওসব কথা। এখন চলো তো আমাদের সেই প্রেমকুঞ্জে! আমি এখুনি তোমার মন ভাল করে দিচ্ছি। এত মদির ভঙ্গীতে আমন্ত্রণ জানাল সে, অন্যসময় হলে এই সুরেলা কণ্ঠের আহ্বানে এতক্ষণে রক্তে বান ডাকত আর্থারের। কিন্তু এখন, এই রাতে, সেই ভয়ঙ্কর জায়গাটায় আবার ফিরে যাওয়ার কথা ভাবতেই শিউরে উঠল আর্থার। ম্যাবেলকে বলল, তারচেয়ে চলো মিউজিক হলে ঘুরে আসি। আসলে এই মুহূর্তে সে মানুষের সরব সঙ্গ কামনা করছে একান্তভাবে। সেই সাথে কিছু মদ পেটে দিতে না পারলে কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছে না। মদ খেয়ে আজ রাতের ভয়াবহ ঘটনাটা ভুলে থাকতে চায় ও।
কিন্তু লোকে লোকারণ্য মিউজিক হলের মত জায়গায় যেতে কিছুতেই রাজি নয়। ম্যাবেল। আর্থার তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করছে না দেখে খুব অভিমান হলো ওর। বলল আর্থার আসলে তাকে আর আগের মত ভালবাসে না। আর্থার বলল ম্যাবেল অযথাই তাকে ভুল বুঝছে। আসলে সে তাকেই ভালবাসে। কিন্তু ম্যাবেলের সেই একই গো। কিছুতেই যাবে না মিউজিক হলে। খুব অভিমানী কণ্ঠে বলল, ঠিক আছে, তোমার যদি একান্তই ইচ্ছে হয় তাহলে তুমি একাই ওখানে যাও, আর্থার নোয়াকস। অনেক মেয়ে পাবে সেখানে। কিন্তু আমাকে আর পাবে না। কারণ আমার প্রতি যে তোমার আর কোনও আকর্ষণ নেই সেটা আমি খুব ভাল করেই বুঝতে পারছি।
আর্থারের শরীর এখনও কাঁপছে। ম্যাবেলের অভিমান ওকে স্পর্শও করল না। সে ভাবল মেয়েরা রাগের মাথায় এমন অনেক কথাই বলে। পরে আবার সোহাগ করালে ভুলে যায়। আর ম্যাবেল যাই বলুক না কেন একটা ব্যাপার ঠিক যে এই টাবনে আর ওই ব্রিজের নিচে প্রেম করার জন্য আসবে না সে। ম্যাবেলকে আরেকবার অনুরোধ করতে যেতেই, তুমি আমার সাথে আর কথা বোলো না, বলে। ম্যাবেল বেগে মেগে একাই বাড়ির পথ ধরল। আর্থার আর কি করা ভঙ্গীতে শ্রাগ কর টন শুরু করল মিউজিক হলের দিকে।
কয়েক পেগ হুইস্কি পেটে পড়তেই এবং স্টেজে সুন্দরী, হাসিখুশি নায়িকার সমধুর কণ্ঠ আর শরীরের হিল্লোল দেখতে দেখতে আর্থার একটু আগের ঘটনা দ্রুত ভুলে যেতে লাগল। ওর মনে হতে লাগল ব্যাপারটা আসলে কল্পনা ছাড়া কিছু নয়। মরে গিয়ে আবার ওভাবে কেউ হাজির হতে পারে নাকি?
আর্থার প্রায় নিশ্চিত ছিল পরদিন ম্যাবেল আবার তার সাথে দেখা করতে দোকানে আসবে। ম্যাবেল এল। কিন্তু একা নয়। তার সাথে আরেক লোক। আর্থারকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করল সে। যেন চেনেই না। ম্যাবেলের এই আচরণে আর্থার মনে মনে খুব রেগে গেল। ঠিক আছে, এভাবে যদি তুমি উঁটি মারো আমিও উঁাট দেখাতে জানি। ভাবল সে। সিদ্ধান্ত নিল শিগগিরই অন্য কারও সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলবে। এমন কেউ যে ম্যাবেলের মত ঢাকঢাক গুড়গুড় স্বভাবের নয়।
ম্যাবেলের পর আর্থার যে রমণীর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ল তার নাম এলিস। অসাধারণ রূপবতী তাকে বলা যাবে না, কিন্তু অসুন্দরীও সে নয়। তার সবচে বড় সম্পদ তন্বী দেহখানা আর ভালবাসায় ভরাট অকৃত্রিম হৃদয়। এলিসের স্বামী নেভীর ক্যাপ্টেন। বছরের বেশিরভাগ সময়ই তাকে বাইরে বাইরে থাকতে হয়। ফলে এলিসের সাথে আর্থারের সম্পর্ক দ্রুত ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠল। অবশেষে এলিস ওকে একদিন বাসায় আসার দাওয়াতও দিল। আর্থার সানন্দে গ্রহণ করল সেই আমন্ত্রণ। উল্লসিত মনে নির্দিষ্ট দিনটিতে হাজির হলো এলিসের বাড়িতে। আজ যে ওকে একান্ত করে পাবে সে এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই।