ওয়্যারউলফ, দেব-দেবী এবং পিশাচ জাদুকর, বলেছিল ভ্যানিং। কিন্তু এখানে তারচেয়েও অদ্ভুত সব লোকজন হাজির, যেন নরক থেকে নেমে এসেছে সব কটা। বীভৎস এবং অশ্লীল ভঙ্গি করছে সবাই। কেউ সেজেছে এক চোখো দানব, কেউ কানা-খোড়া, কেউ আবার পিশাচ। কালো জাদুকরদেরও চোখে পড়ল। বিকট চেহারার ডাইনীও নজর এড়াল না।
এবার ভ্যানিং-এর তাড়ায় ভিড়টার সাথে মিশে যেতে হলো আমাকে, সবার সাথে পরিচয় হলো। মুখোশ খুলতেই একেকজন নিপাট চেহারার ভদ্রলোক এবং সুন্দরী নারীতে রূপান্তরিত হলো।
প্রায় ডজনখানেক অতিথি উপস্থিত ঘরে। পরিচয় হলেও খুব দ্রুত ভুলে গেলাম সবার নাম। ভ্যানিং আমার কনুই ধরে টেনে নিয়ে গেল এক কোণে। আরে, এদের সাথে কথা বলে সময় নষ্ট করছেন কেন? গলা নামাল সে। আমার সাথে আসুন। আসল লোকদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিই।
ঘরের এক কোণে চারজনের একটা দল বসে ছিল। সবার পরনে ভ্যানিং-এর মত পুরোহিতদের পোশাক। এক এক করে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল ভ্যানিং।
ড. ডেলভিন, বুড়ো এক মানুষ, বেবিলোনিয়ান। আঁতিয়েন ডি মারগনি, অ্যাডোনিসের প্রিস্ট, হ্যান্ডসাম। গায়ের রঙ কালো।
প্রফেসর উইলড্যান, দাড়িওয়ালা, প্রায় বামন আকৃতির মানুষটা। মাথায় পাগড়ি।
রিচার্ড রয়েস, অল্পবয়েসী, বুদ্ধিদীপ্ত চেহারার তরুণ।
চারজনেই বিনীত ভঙ্গিতে আমার দিকে চেয়ে নড় করল। ভ্যানিং বলল, আমার দলের এই চারজনই আসল লোক। আমরা সবাই প্রেত চর্চায় বিশ্বাসী।
চমকালাম না। কারণ অকাল্ট শাস্ত্রের প্রতি যাদের প্রবল খিদে, প্রেত চর্চায় তাদের একটু-আধটু আগ্রহ থাকেই।
এই যে চারজনকে দেখছেন এদের মধ্যে আমার বাঁ পাশের জন অর্থাৎ ড. ডেলভিন এদেশের সবচেয়ে নামকরা জাতি বিজ্ঞানী। ডি ম্যারিগনি প্রখ্যাত অকালটিস্ট-র্যানডলফ কার্টারের সাথে যার এক সময় যোগাযোগ ছিল। রয়েস আমার পার্সোনাল এইড, আর প্রফেসর উইলড্যান বিখ্যাত মিশর-বিজ্ঞানী। ভারি মজা তো! ভাবলাম আমি। মিশর নিয়ে গল্প লিখছি। এখানেও সেই মিশর।
আপনাকে কিছু ইন্টারেস্টিং জিনিস দেখানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। অবশ্যই তা দেখতে পাবেন। আধঘণ্টাটাক আমাদেরকে এই পার্টিতে কাটাতে হবে। তারপর আসল সেশন করতে আমরা ওপরে, আমার ঘরে যাব। আশা করি ততক্ষণ ধৈর্য ধরে থাকবেন।
ভ্যানিং আমাকে নিয়ে আবার ঘরের কেন্দ্রের দিকে এগোতে শুরু করলে ওরা চারজন বো করল। নাচ থেমে গেছে, ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে সবাই গল্প-গুজবে মত্ত। দুএকজনের সাথে হালকা দুএকটা কথাও বললাম। এইসময় দেখলাম—তাকে।
স্রেফ এডগার অ্যালান পোর গল্প মনে পড়ে গেল আমার তাকে দেখে। ঘরের শেষ মাথার কালো-সবুজে মেশানো পর্দা ফাঁক হয়ে গেল, সে পা রাখল ভেতরে, যেন মাটি ফুঁড়ে বেরুল আগন্তুক।
মোমের রূপালী আলো পড়েছে তার গায়ে, হাঁটতে শুরু করল সে, প্রতিটি পদক্ষোপে অশুভ এবং ভয়ঙ্কর কি যেন একটা বিচ্ছুরিত হতে লাগল তার শরীর থেকে। এক সেকেণ্ডের জন্য মনে হলো বুঝি একটা প্রিজমের মাঝখান থেকে দেখছি তাকে, কাপা আলোয় তার নড়াচড়া আমার কাছে অস্পষ্ট এবং ক্ষীণ মনে হলো।
মিশরের আত্মা সেজে এসেছে সে।
লম্বা, সাদা আলখেল্লায় ঢাকা তার হাড্ডিসার শরীর। ঝুলঝলে আস্তিন থেকে বেরিয়ে আসা হাতদুটো পাখির নখের মত বাঁকানো, দামী আংটি পরা আঙুলের মুঠিতে ধরে আছে সোনার একটা লাঠি, আই অভ হোরাসের চিহ্ন সীল করা।
আলখেল্লার ওপরের অংশটা কালো, গলা কাটা; ওটার ওপরে, ঘোমটার আড়ালে উঁকি দিচ্ছে ভৌতিক একটা মাথা।
মাথাটা কুমিরের। আর ধড়টা মিশরীয় পুরোহিতের।
মাথাটা-এক কথায় ভয়ঙ্কর। কুমিরের মাথার মতই খুলির দিকটা ঢালু, ওপরটা সবুজ আঁশে ভরা; লোমশূন্য, পাতলা, চকচকে, দেখলে বমি আসে। বড় বড় হাড়ের কাঠামোর মাঝখানে অক্ষিকোটর, লম্বা, সরীসৃপ আকৃতির নাকটার পেছনে এক জোড়া চোখ, কটমট করে তাকিয়ে আছে। কোচকানো নাকের ফুটো, শক্ত এবং কঠিন দুই চোয়াল সামান্য ফাঁক হয়ে আছে, বেরিয়ে পড়েছে গোলাপী লকলকে জিভ, খুরের মত ধারাল দাঁতের সারিসহ।
মুখোশ বটে!
আমি প্রশংসার চোখে ওটার দিকে চেয়ে আছি, হঠাৎ যেন ঝাঁকি খেলাম একটা। এখানকার মুখোশধারীদের চেয়ে এই কুমির-মানবের মুখোশটা যেন অনেক বেশি জীবন্ত, মনে হয় সত্যি।
লোকটা বোধহয় একা এসেছে, ওর সাথে কাউকে সেধে কথা বলতেও দেখলাম না। ভ্যানিং-এর কাছে এক লাফে পৌঁছে গেলাম আমি, কাঁধে টোকা দিলাম। লোকটার সাথে পরিচিত হবার ইচ্ছে জেগেছে আমার।
ভ্যানিং আমার দিকে নজর দিল না। সে ব্যস্ত ব্যান্ড পার্টির এক লোকের সাথে কথা বলতে। আমি মাথা ঘুরিয়ে তাকালাম, কুমির-মানবের সাথে নিজেই আলাপ করব ভেবে।
চলে গেছে সে।
তীক্ষ্ণ নজর বোলালাম উপস্থিত অভ্যাগতদের ওপর। লাভ হলো না কোন। নেই সে। যেন হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেছে।
অদৃশ্য হয়ে গেল? লোকটার অস্তিত্ব সত্যি ছিল কি? ওকে আমি দেখেছি-বরং বলা যায় এক পলকের জন্য ওকে আমার চোখে পড়েছে। নাকি আদৌ সে এখানে ছিল না। গোটা ব্যাপারটাই হয়তো আমার কল্পনা। যেভাবে মিশর নামের দেশটা আমার মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাচ্ছে তাতে দৃষ্টিবিভ্রম হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। তাহলে মনের মধ্যে খচখচ করে কেন? কেন মনে হয় কল্পনা নয়, বাস্তবিকই দেখেছি আমি তাকে।