আগুনের পাশে, বড় ইজি-চেয়ারটাতে শরীর মুচড়ে বসে আছে মার্থা, বই পড়ছে। কাজ না থাকলে এ কাজটাই সবসময় করে সে। বই পড়ার নেশা তার সাংঘাতিক। আর সিরিয়াস সব বিষয়ের প্রতি আগ্রহ বেশি। তবে একটা বিষয়ের সাথে বেশিদিন সেঁটে থাকে না। হয়তো এ মাসে তাকে দেখা গেল জ্যোতির্বিদ্যা নিয়ে পড়ে থাকতে, সামনের মাসে হয়তো ডুবে যাবে বোটানির জগতে, পরের মাসে অঙ্ক নিয়ে ব্যস্ত থাকবে কিংবা ব্যালের ইতিহাস নিয়ে ঘাটাঘাটি করবে। তবে যে বইই পড়ুক না কেন, খুব আগ্রহ নিয়ে পড়ে মার্থা। ইদানীং তাকে চিকিৎসা শাস্ত্রের নেশায় পেয়ে বসেছে। ডাক্তার, ড্রাগস, অ্যানাটমি, সার্জারী ইত্যাদি বিষয়ের ওপর যত বই সে পাচ্ছে পাবলিক লাইব্রেরীতে, সব বাড়িতে নিয়ে আসছে। সেদিন পল হাসতে হাসতে মার্থাকে বলছিল, আমাদের হাউজ ফিজিশিয়ানের আর কি দরকার, বাজি ধরতে পারি, তুমি ওনার চেয়ে অনেক বেশি জেনে ফেলেছ এ কদিনে। হালকা এই রসিকতায় কিন্তু হাসেনি মার্থা। কোন রসিকতায় সে হাসে না।
তবে পলকে অবাক করে দিয়ে আজ হাসল মার্থা। ওর ধারণাই সত্যি হলো। ওকে অসময়ে ফিরতে দেখে মোটেও অবাক হয়নি মার্থা। হাসি দিয়ে শুধু বুঝিয়ে দিল পলকে দেখে সে খুশি হয়েছে।
হ্যালো, ডিয়ার, বলল মার্থা। তোমার বিজনেস অ্যাপয়েন্টমেন্ট ক্যানসেলড় নাকি?
হ্যাঁ। বিকেলে ফোন করে বলল আজ ওরা বসতে পারবে না।
ভালই হলো। সারাদিন অফিস করার পরে তোমাকে আবার রাত জেগে কাজ করতে হবে না। বসো তুমি। আমি খাবারের ব্যবস্থা করছি।
দুঃখিত, বলল পল। তোমাকে জানানো উচিত ছিল রাতে আমি বাড়ি ফিরছি।
দুঃখিত হবার কিছু নেই। ফ্রিজে সবসময়ই কিছু না কিছু খাবার থাকেই। লিভার আর বেকনের সাথে সুস্বাদু কিডনি চলবে?
চলবে মানে দৌড়াবে। খুশি হয়ে উঠল পল। তুমি সত্যি চমৎকার একটা মেয়ে। একই সাথে বিবেকের দংশন অনুভব করল সে। বউটাকে শুধু শুধু ঠকাচ্ছে সে। আজ মার্থাকে দেখতেও সুন্দর লাগছে। সেজেছে বোধহয়।
তোমাকে বেশ সুন্দর লাগছে। ব্যাপারটা কি? জিজ্ঞেস করল পল।
আজ দিনটা বেশ ভাল গেছে আমার। কেন?
না, মানে, এত হাসিখুশি আগে দেখিনি তো!
হ্যাঁ, জবাব দিল মার্থা। আমি আজ বেশ সুখেই আছি।
এক মুহূর্তের জন্য সন্দেহটা খোচা দিল পলকে, মার্থার গোপন নাগর-টাগর নেই তো? পরক্ষণে চিন্তাটা ঝেটিয়ে বিদায় করে দিল মাথা থেকে। মার্থা এমন কাজ করতেই পারে না। করলে শুক্রবার রাতটাকেই ব্যবহার করত সে, যে সময়টাতে সে বাইরে থাকে। কিন্তু মার্থা এতই বিশ্বস্ত যে স্বামীর অনুপস্থিতির অন্যায় কোন সুযোগ নেয়নি, শুধু বইয়ের মধ্যে মুখ গুঁজে থেকেছে। ঈশ্বর ওর মঙ্গল করুন!
আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি। তুমি ততক্ষণ এই ড্রিংকটাতে চুমুক দিতে থাকো। শেরীর একটা গ্লাস ওর হাতে ধরিয়ে দিল মার্থা। অতিথির জন্য এই একটা মালকোহলই ওরা বাড়িতে রাখে। স্বামীকে বিশ্রামের সূযোগ দিয়ে কান্নাঘরে ঢুকল স্ত্রী।
শেরীর গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে অন্যান্য শুক্রবারের সাথে আজকের দিনটার পার্থক্য মেলাতে চেষ্টা করছিল পল। প্রায় নটা বাজে। এতক্ষণে সে আর এস্টেল কয়েকটা ডাবল জিন মেরে দিয়ে ফায়ার প্লেসের সামনের মেঝেতে পাতা ফারের কম্বলের ওপর শুয়ে শরীরের বন্দনায় মেতে উঠত, রেকর্ড প্লেয়ারে বাজত জ্যাজ মিউজিক-যে ধরনের মিউজিক মার্থার একেবারেই অপছন্দ। সে ঠাণ্ডা গান পছন্দ করে। তার সমস্ত অনুভূতিই ঠাণ্ডা আর ভোতা।
মার্থা যে মোটা বইটা এতক্ষণ পড়ছিল, ওটা উল্টেপাল্টে দেখল পল। চিকিৎসা শাস্ত্র। পাতা ওল্টাতে গিয়ে নগ্ন নারীদেহের আঁকা ছবি চোখে পড়ল। ছবিটা দেখে তেমন মজা পেল না সে। মেয়েদের শরীর-বৃত্তান্ত। এঁকে দেখানো হয়েছে নানা ইন্টারন্যাল অর্গান, মেডিকেলের ছাত্রদের খুব উপকারে আসবে এই নিখুঁত বর্ণনা। মেয়েরা নিশ্চয়ই নিজেদের ন্যাংটো শরীরের অ্যানাটমি দেখে মজা পাবে না। সে মুখ বিকৃত করে বন্ধ করল বইটা, ছুঁড়ে দিল চেয়ারের ওপর। তারপর জ্যাকেটের পকেট থেকে পেপার ব্যাক থ্রিলার বের করে তাতে মনোনিবেশ করল।
বইটার প্রচ্ছদে স্বর্ণকেশী, উদ্ভিন্নযৌবনা এক সুন্দরীর ছবি। তার দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে কিছুই নেই। মেয়েটার ফিগার অবিকল এস্টেলের মত, তবে এস্টেলের চুল অত লম্বা নয়। এস্টেল আজ ওকে ধোকা দিয়েছে মনে পড়তেই তিড়বিড় করে জ্বলে উঠল ভেতরটা। শুক্রবার রাত তার আনন্দের রাত। আর আজ কিনা তাকে এভাবে গোবেচারা হয়ে বাড়িতে বসে থাকতে হচ্ছে!
মন থেকে বিরক্তি আর রাগ দুটোই উধাও হয়ে গেল মার্থাকে খাবার নিয়ে আসতে দেখে খুশি হয়ে উঠল পল। লিভার, কিডনি, বেকন…প্রতিটি আইটেমই দারুণ বেঁধেছে মার্থা। পেটে খিদে ছিল, প্লেট চেটেপুটে খেল সে। শেষে পরিতৃপ্তির ঢেকুর তুলে বলল, দারুণ হয়েছে রান্না!
হবেই তো। আজ বিশেষভাবে বেঁধেছি যে, বলল মার্থা।
তুমি খুব ভাল মেয়ে। আর তোমার ওপর খুব সহজে আস্থা রাখা যায়, আদুরে গলায় বলল পল।
আস্থা আসলে রাখা যায় তোমার ওপরে, বলল মার্থা।
মানে?
এই যে তোমাকে যা দিই সব চেটেপুটে খেয়ে নাও।
খাব না কেন? তোমার রান্নার হাত এত ভাল!
এ কারণেই তোমাকে বোকা বানানো আমার জন্য সহজ হয়েছে।