আকাশে বিদ্যুৎ জ্বলে উঠলেই হলো, সামান্য ছোঁয়াও যদি এই পাইরোক্সিলিনে লাগে, সঙ্গে সঙ্গে মাঝ আকাশে ধ্বংস হয়ে যাবে ওই ঘুড়ি। আমি তামার তারটিকে গাছের সঙ্গে ভাল করে বাঁধলাম, তারপর মালমশলা জড়ানো কাগজটিকে ওটার সঙ্গে বেঁধে দিলাম।
কাজ করতে করতে কাছিয়ে এল ঝড়। ঘুড়িটি জঙ্গলের ঢেউ খেলানো গাছগুলোর ওপর উড়তে শুরু করল।
আমি তারটিকে খুলে দিলাম। তারের সঙ্গে বাঁধা কাগজের টুকরোটি এক মুহূর্তের জন্য নট নড়ন চড়ন হয়ে থাকল, তারপর মৃদু গুঞ্জন তুলে তারের সঙ্গে ওটা উঠতে লাগল ওপরের দিকে। আমি আর দেরী করলাম না। ফিরে চললাম সাম্পানের উদ্দেশে। বাইতে শুরু করলাম বৈঠা।
বাড়ি ফিরে দেখি ফে কর্লিনের কালেকশন রুমের কটে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। ঘরের শেষ মাথার জানালার কাছে উঁকি মেরে দাড়িয়ে আছে ক্যান্টোনিজ ছোকরা কাংচো।
আমি ফে-র কজি চেপে ধরে বসে থাকলাম। কর্লিন ঘরের মধ্যে পায়চারি শুরু করল। কাংচোকে দেখেও না দেখার ভান করল।
ঘরের কোণে, কাঠের বাক্সে রাখা তিব্বতী সেই সিল্ক কাপড় খণ্ডকে দেখলাম অনেকখানি বেরিয়ে আছে বাইরে। লাল রঙটাকে আরও উজ্জ্বল এবং তীব্র লাগছে।
ঝড় বোধহয় এসেই গেল। পুবাকাশ থেকে ছুটে এল বিশাল এক টুকরো কালো মেঘ, ধেয়ে গেল জঙ্গলের দিকে। পরক্ষণে সাপের জিভের মত ঝলসে উঠল বিদ্যুৎ ঠিক ঘুড়িটির কাছে। প্রচণ্ড বজ্রপাতের শব্দে গোটা বাড়ি কেঁপে উঠল থরথর করে।
পাঁচ সেকেন্ড পর আকাশে জ্বলে উঠল আগুনের বিশাল এক চাবুক, খোলা জানালার ওপরে। চাবুকটা আঘাত হানল ড্রাগন লেজটাকে, তামার তারটি সঙ্গে সাতে জ্বলে উঠল দাউদাউ করে, সাপের মত পাক খেতে লাগল। পরমুহূর্তে ঘুড়িটি নেই হয়ে গেল চোখের সামনে থেকে।
কটে শুয়ে থাকা মেয়েটির সারা শরীর নাড়া খেল প্রবলবেগে। মুখ দিয়ে গোঙানি বেরিয়ে এল। নাড়ি কাঁপতে লাগল থরথর করে। তারপর ধীরে ধীরে বিট স্বাভাবিক হয়ে এল, আমি স্বস্তিসূচক চিৎকার দিলাম।
সাফল্যের উল্লাসের স্বাদ অনুভব করার আগেই কাংচো-র গগনভেদী চিৎকারে আঁতকে উঠলাম আমি। ছেলেটা বিস্ফারিত চোখে চেয়ে আছে রক্তলাল সিল্কের কাপড়ের টুকরোটির দিকে।
স্তম্ভিত হয়ে দেখলাম কাপড়টি থেকে ধোঁয়া উঠতে শুরু করেছে, পরক্ষণে দপ করে আগুন জ্বলে উঠল ওটাতে।
গুঙিয়ে উঠল কর্লিন। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল, যেন নড়তে ভুলে গেছে। কাঠের বাক্সটির মুখ খুলে গেল কারও অদৃশ্য হাতের কারসাজিতে, সাপের মত জটা মেরে একেবেঁকে বেরুতে শুরু করল জুলন্ত সিল্কের টুকরো। তারপর বাতাসে যেন পাখা মেলল ওটা, ভাসতে থাকল ঘরের মধ্যে।
কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে জ্বলন্ত এবং জ্যান্ত কাপড়ের টুকরোটি ছুটে গেল কর্লিনের দিকে। পালাতে চেষ্টা করল কর্লিন, কিন্তু ওর পা যেন গেঁথে থাকল মেঝের সঙ্গে, ভীত এবং হতভম্ব হয়ে সম্মোহিতের মত চেয়ে রইল সে ছুটে আসা মৃত্যু দূতের দিকে। আতঙ্কিত আমি দেখলাম জ্বলন্ত সিল্ক টুকরো সাপের মত পেঁচিয়ে ধরল কলিনকে! ওকে রক্ষা করার জন্য এগিয়ে যেতে চাইলাম সামনে। কিন্তু অদৃশ্য। কোন শক্তি এক পাও এগুতে দিল না আমাকে নিজের জায়গা থেকে।
ভয়ঙ্কর চিৎকার করে মেঝেতে ছিটকে পড়ল কর্লিন। ধোয়ার বিশাল এক পর্দা ঘিরে ফেলল ওকে। মাংস পোড়ার তীব্র গন্ধ ভেসে এল নাকে।
এই সময় আমি নড়ে উঠলাম, দৌড় দিলাম সামনের দিকে। দুই হাত দিয়ে কাপড়ের টুকরোটিকে ছুটিয়ে আনতে চাইলাম কর্লিনের শরীর থেকে। কিন্তু ওটা যেন জোকের মত সেঁটে থাকল তার শিকারের গায়ে। একটা কম্বল চোখে পড়ল আমার অদূরে, ওটা দিয়ে আগুন নেভানোর প্রাণপণ চেষ্টা করলাম। কিন্তু লাভ হলো না কোনও, বরং শিখা আরও লকলক করে উঠল।
শেষ মরণ চিৎকারটা দিয়ে স্থির হয়ে গেল কর্লিন। উপুড় হয়ে পড়ে থাকল।
জানুয়ারির ২৯ তারিখ সামারিভা ত্যাগ করল ফে। আমি এক হপ্তা পর যাত্রা শুরু করলাম সিঙ্গাপুর অভিমুখে। কিন্তু কাংচো-র টিকিটির দেখাও পেলাম না কোথাও।
এডওয়ার্ড কর্লিনের মৃত্যুর জন্য ক্যান্টোনিজ এই ছোকরা যে দায়ী তা আমি ডাচ কর্তপক্ষকে বলতে পারতাম। অথবা এই ঘটনার ওপর একটি তদন্ত করার দাবিও জানাতে পারতাম। কিন্তু এগুলো করে কলোনিয়াল কোর্ট অভ ল যে কথা জানতে পারত তা তাদের কাছে অবিশ্বাস্য এবং অসম্ভব বলেই মনে হত।
পুরো ব্যাপারটাকে আমি আমার দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারি। যেমন, আমি কলিনের বাড়িতে গ্যাসোলিনের একটি ক্যান আবিষ্কার করেছিলাম। তাছাড়াও ওই বাড়িতে আমি খুঁজে পেয়েছি একগোছা তার, তার গোছা কালেকশন রুমে ছিল। সম্ভবত বাঁশের কার্টেনের সাপোটিং লাইন হিসেবে ওগুলোর ব্যবহার করা হত। এবং এই তার থেকে সৃষ্ট আগুন ওই সিল্কের কাপড়ে আগুন লাগার কারণ হিসেবে বলা যায়। আর কাংচো-র ব্যাপারে যে কথাটি আমি জেনেছি তা হচ্ছে সে আদৌ ক্যান্টোনিজ নয়, সে আসলে সেই নিষিদ্ধ মন্দির পো ইয়ান কুয়ান, যেখান থেকে কর্লিন অগ্নি দেবতার বস্ত্র চুরি করেছিল, সেখানকার এক প্রাক্তন সন্ন্যাসী, একজন তিব্বতী।
কিন্তু তারপরও সেই ভৌতিক ঘুড়ি, কর্লিনের স্ত্রীর মৃত্যু এবং তার কন্যার জীবনে সেটার অদ্ভুত প্রভাব, এসব প্রশ্নের জবাব আমি খুঁজে পাইনি। শুধু জ্বরের কারণে এলিস মারা গেছে কিংবা ফে অসুস্থ হয়েছে, এই কথা আমি বিশ্বাস করি না।