বস্ত্রখণ্ডটির সকল সৌন্দর্য নিহিত এর মাঝখানে, ড্রাগনের ছবি আঁকা ডিজাইনটির মধ্যে। আমি ঠিক নিশ্চিত নই, তবে জানি সকল পৈশাচিক পূজা অর্চনা এই ড্রাগনের নামেই করা হয়। এশিয়ার সবচে অজ্ঞাত ধর্মগুলোর মধ্যে এটিও একটি ধর্মটি প্রেতপূজার ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং…
আমি কাছে এসে কাপড়টি পরীক্ষা করে দেখলাম। ডানদিকের নিচের অংশটি হেঁড়া লক্ষ করলাম।
যে চোরটা ওটা হাতাবার চেষ্টা করেছিল সে এই কাজ করেছে, ঘোঁতঘোঁত করে উঠল কর্লিন। তবে কাপড়টা নিয়ে যাওয়ার আগেই আমি এসে উপস্থিত হই। সে ওইটুকু ছিঁড়ে অন্ধকারে পালিয়ে যায়-কি হয়েছে, ফে?
কলিনের মেয়ে এসে ঢুকেছে ঘরে। তার মুখ কাগজের মত সাদা।
তাড়াতাড়ি, ডাক্তার, কেঁদে উঠল সে, আমার মা…
বিদ্যুৎবেগে আমি এলিসের ঘরে ঢুকলাম। তার পাশে বসেই বুঝতে পারলাম সমস্ত ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে সে। মারা গেছে এলিস কর্নিল।
স্পন্দনহীন কজিটি হাতে ধরে আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। আতঙ্কিত হয়ে উঠলাম সঙ্গে সঙ্গে। ঘুড়িটি ধীরে ধীরে নেমে আসছে নিচে। গাছের মাথায় আছড়ে পড়ল ওটা, পরক্ষণে অদৃশ্য হয়ে গেল ঘন জঙ্গলে।
সামারিন্ডা ত্যাগ করার জন্য যেভাবে ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম, এলিস কর্লিনের অস্বাভাবিক মৃত্যু আমার সেই ব্যস্ততার আগুনে জল ঢেলে দিল। ডেথ সার্টিফিকেট যদিও লিখলাম অতিরিক্ত ম্যালেরিয়া জ্বর এলিসের মৃত্যুর কারণ, ন্তুি আমি জানি কারণটা আরও রহস্যময়, আরও গভীরে প্রোথিত।
ঘুড়িটিকে সগ্রহ করেছি আমি। কর্লিনের বাড়ির কাছে ডায়াক অধিবাসীরা তামাকের বদলে ওটাকে দিয়ে গেছে আমায়। জিনিসটা বাঁশ আর রাইস পেপার দিয়ে তৈরি, যেমন ধারণা করেছিলাম আমি। কিন্তু ওপরের অবশিষ্টাংশে ছোট এক টুকরো লান্স সিল্ক কাপড় সিরিশ দিয়ে জোড়া লাগানো।
গন্ধ শুঁকলাম। কর্লিনের সেই অগ্নি দেবতার পূজার বেদির কাপড়ের গন্ধ!
হপ্তাখানেক পর কর্লিন এল আমার বাড়িতে। বারান্দায় মুখোমুখি বসলাম দুজনে। কর্লিনকে ভয়ানক উদভ্রান্ত লাগছে।
ভ্যান রুলার, বলল সে। আবার আরেকটা ঘুড়ি।
কি? চিক্কার করে উঠলাম।
মাথা ঝাঁকাল কর্লিন। অবিকল আগেরটার মত। একই সাইজ, একই রং, একই রকমের তার, দিন দুই ধরে দেখতে পাচ্ছি ওটাকে। তবে মনে হয় রাতের বেলা ওটা অদৃশ্য হয়ে যায়। আমার মেয়ে ফে…
ওকেও ধরেছে? ভয়ে কেঁপে উঠলাম আমি।
কর্লিন হাত মুঠি করল। এলিস যেভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল সেভাবে নয়। মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে ফে। কোনও দুষ্ট আত্মা ওকে ক্রমশ গ্রাস করে চলেছে।
এবার নিজে থেকেই বললাম, ফে-কে দেখতে যাব আমি। কর্লিনকে অপছন্দ করলেও ঘটনাটা আমাকে যেন সম্মোহিত করে তুলছিল। কর্লিনকে জানালাম ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আমি সাম্পানে চড়তে যাচ্ছি।
রাতে প্রচুর বৃষ্টি হওয়ার কারণে আকাশের মুখ কালো। কাংচোকে নিয়ে। সাম্পানে চড়ে বসলাম আমি। ও সাম্পানের পেছনে বসে ডায়াক মাঝিদের নির্দেশ দিতে লাগল।
গতবারের ঘুড়িটি যে জায়গায় দেখেছিলাম ঠিক একই স্থানে এই ঘুড়িটিকেও দেখলাম। নদীঘাটে সাম্পান ভেড়ার আগ পর্যন্ত এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলাম ঘুড়িটির দিকে। কিন্তু কোনও মন্তব্য করলাম না।
কিছুক্ষণ পর ফে কর্লিনের সঙ্গে দেখা করলাম আমি। ঘরের মাঝখানে একটি চেয়ারে পাথরের মূর্তি হয়ে বসে আছে মেয়েটি। চোখ দুটো সামনের দিকে স্থির। একটি মুখোশ যেন পরে আছে সে, ঠোঁট দুটো রক্ত শূন্য।
মিনিট পাঁচেক ওর সঙ্গে আস্তে আস্তে কথা বলার চেষ্টা করলাম আমি। কিন্তু ফে কোনও কথা বলল না। হঠাৎ সে দাঁড়িয়ে পড়ল, গলা চিরে বেরিয়ে এল সুতীব্র আর্তনাদ। পরমুহূর্তে মরা মানুষের মত ধপাস করে পড়ে গেল মেঝের ওপর। আমি ওকে পরীক্ষা করার জন্য এগিয়ে গেলাম বটে, কিন্তু ভয়ে আমার বুক ইতোমধ্যে ধড়ফড় শুরু করে দিয়েছে।
ঘুড়িটি আবার তার কাজ শুরু করে দিয়েছে!
কিন্তু এবার আর ব্যাপারটাকে সহজে ছেড়ে দেব না প্রতিজ্ঞা করলাম। মেয়েটির শারীরিক সামর্থ্য ওই ঘুড়ির ওঠা নামার ওপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল। অবিশ্বাস্য হলেও ব্যাপারটা সত্য। ঘুড়িটিকে টেনে নামানো যাবে না, তাহলে মেয়েটি মারা যাবে, ওকে মাঝ-আকাশে ধ্বংস করতে হবে।
ওষুধের বাক্সটা নিয়ে দৌড়ে ঘর থেকে বেরুলাম আমি। জঙ্গলের মধ্যে থেকে দৌড়াতে দৌড়াতে চলে এলাম নদীর ঘাটে। চড়ে বসলাম সাম্পানে। তীর লক্ষ্য করে বৈঠা বাইতে শুরু করলাম সর্বশক্তি দিয়ে।
আকাশে ঝড়ো মেঘ জমেছে, ঝড়ের পূর্বাভাস। তামার তারটিকে অনুসরণ করে আমি তীরে চলে এলাম, ঢুকলাম জঙ্গলে।
তারটি এখনও সেই পালাপাক গাছের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। আমি ওষুধের বাক্স খুলে কাজে লেগে গেলাম।
প্রথমেই বের করলাম পাইরোক্সিলিন, স্প্রে করে দিলাম সামনে। ইথার এবং অ্যালকোহলের সঙ্গে চল্লিশ গ্রাম পাইরোক্সিলিন মেশালে তৈরি হয় কলোডিয়ন, ছোটখাট ক্ষত সারাবার মহৌষধ। আসলে পাইরোক্সিলিন গানকটন ছাড়া অন্য কিছু নয়।
বাক্স থেকে একটি ব্রাশ টিউবও বের করলাম। ওটার দুটো মুখেই বারুদের ক্যাপ পরানো। ক্যাপ দুটো খুলে ওগুলোর মধ্যে গানকটন ঢোকালাম! পকেট থেকে একটা বড় কাগজের টুকরো বের করলাম, তারপর ঘড়ির চেইনটি খুললাম।
বাচ্চাদের ঘুড়ির লেজেতে বেঁধে খবর পাঠাতে দেখেছেন? আমিও তাই করতে যাচ্ছি। তবে পার্থক্য হলো আমার খবর হচ্ছে বিস্ফোরক গানকটন।