নতুন স্কুলের ছেলেমেয়েগুলো এত বাজে হবে জানত না রবিন। জানলে এ স্কুলে ভর্তি হত না। বাবা-মা ঢাকা থেকে তাড়াতাড়ি চলে গেলেই ভাল। এরকম পচা সহপাঠীদের সঙ্গে বেশিদিন সহাবস্থান করতে পারবে না রবিন। রবিনের মুখ শুকনো দেখে মা জানতে চাইলেন, কী হয়েছে রে? মা পেছনের ঘরে কাজ করছিলেন। হাতে মাটি লেগে আছে। তোয়ালেতে হাত মুছতে মুছতে বললেন, তোর চেহারা এমন দেখাচ্ছে কেন?
আজ হ্যালোউইন ডে, মা, গুঙিয়ে উঠল রবিন, ধপ করে বসে পড়ল একটা সোফায়। স্কুলের সবাই হ্যালোউইন ডে পালন করবে ঠিক করেছে। আমি ওদের সাথে যোগ দিতে চাইলাম। কেউ আমাকে নিল না। তাছাড়া হ্যালোউইন ডে-তে পরার মত কোন ড্রেসও আমার নেই।
হ্যালোউইন ডে-র মজা হয় রাতে, সান্ত্বনার সুরে বললেন মা। হাতে ঢের সময় আছে। তোকে একটা ড্রেস বানিয়ে দেবখন।
রবিনের বাবা দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ছিলেন, রাবারের গ্লাভ পরা হাতে একটা গাছ। হ্যালোউইন ডে তো পালন করে আমেরিকা-ইউরোপের ছেলেমেয়েরা। তোদের স্কুলেও এসব পালন করা হয় নাকি?
আমাদের স্কুলে হয় শুনেছি, মুখ গোমড়া হয়ে আছে রবিনের। টিভিতে দেখেছি হ্যালোউইন নাইটে অনেক মজা হয়। নানা রকম ভূতুড়ে মুখোশ পরে সবাই…
তোর স্কুলের ছেলেমেয়েরা কে কী পরবে? জিজ্ঞেস করলেন মা!
ওরা বলল সবাই নাকি চুলে রঙ করাবে, তারপর মুখোশ পরবে, মুখে থাকবে বড় বড় দাত। তবে সবাই একই রকম সাজবে। আমি অন্যরকম সাজতে চাই।
হঠাৎ হেসে উঠলেন বাবা। আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে, বললেন তিনি। তুই প্রতিদিন যেভাবে স্কুলে যাস, আজ রাতে সেভাবে যাস না কেন? স্বাভাবিক পোশাকে?
দারুণ বুদ্ধি, বাবাকে তারিফ করলেন মা। সবাই ডাইনী বা ভূত সেজে আসবে। আর তুই যাবি স্বাভাবিক চেহারা নিয়ে। বেশ মজা হবে।
মোটেই মজা হবে না, গোমড়া মুখে আরও আঁধার ঘনাল রবিনের। ওরা ভাববে হ্যালোউইন ডে-তে পরার মত কোন ড্রেসই আমার নেই। আমি ফকির।
আরে, ওরা তো সবাই সেই পুরানো সাজেই সাজবে, ওকে উৎসাহ দিতে চাইলেন বাবা। একমাত্র তুইই কোন ড্রেস পরবি না। তোর সাজটা হবে সবার থেকে আলাদা। দেখবি সবাই কেমন বেকুব বনে গেছে।
মনে মনে কী যেন ভাবল রবিন। তারপর হাসি ফুটল ওর মুখে। কথাটা মন্দ বলোনি, বাবা। আমাকে সাধারণ পোশাকে দেখে ওরা বেকুব বনেও যেতে পারে। আর আমাকে দেখে বোকা না বলে বুঝব ব্যাপারটা ওদের মাথাতেই ঢোকেনি।
এই তো ব্যাটা ছেলের মত কথা! সাবাস দিলেন বাপ তার সন্তানকে। রবিন তক্ষুণি স্কুল ব্যাগ নিয়ে ঢুকে পড়ল নিজের ঘরে। মা এলেন পিছু পিছু। বললেন, শুনেছি, তোর সহপাঠীগুলো তেমন ভাল না। তাই একটু সাবধানে থাকিস। ওরা যদি তোকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টাও করে কিছু বলিস না যেন।
কিছু বলব না, মা, মাকে আশ্বস্ত করে রবিন। দাঁড়ায় ড্রেসিং টেবিলের সামনে। চুল আঁচড়াতে থাকে।
সন্ধ্যার পরপর বেরিয়ে পড়ল রবিন। এদিকটা এমনিতেই নির্জন, সন্ধ্যার পরে লোক চলাচল আরও কমে যায়। রাস্তার সোডিয়াম বাতির মরাটে আলোয় কেমন ভূতুড়ে লাগে চারপাশ। নির্জনতা যেন ছেকে ধরে রবিনকে। ভয় ভয় লাগে। ও দ্রুত পা চালায় স্কুলের দিকে। ওখানেই পালন করা হবে হ্যালোউইন নাইট।
বড় রাস্তার মোড়ের ধারে চলে এসেছে রবিন, এমন সময় দেখতে পেল দলটাকে। রাস্তার পাশের একটা বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে ওরা। পিশাচদের একটা দল। ভূত, প্রেত, ভ্যাম্পায়ার সবাই আছে সেই দলে। ওদের সঙ্গে যোগ দেয়ার আশায় দ্রুত পা চালাল রবিন।
রবিনকে দেখে ফেলল ওরা। ওটা কেরে? ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের মুখোশ পরা একজনের ফাসফেসে গলা শোনা গেল।
কঙ্কাল সাজা একজন রবিনের পাঁজরে গুঁতো দিল আঙুল দিয়ে। তোমাকে তো কেউ আসতে বলেনি।
জিন্দালাশের মুখোশ পরা আরেকজন লম্বা নখ বাগিয়ে প্রায় ঝাপিয়ে পড়ল রবিনের ওপর। বু! বিকট চিৎকার দিয়ে উঠল সে।
ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেল রবিন, হুমড়ি খেয়ে পড়ল একটা ঝোপের ওপর। হা হা করে হেসে উঠল সবাই। তারপর হাটা দিল।
কে রে ছেলেটা? বড় রাস্তায় উঠে পড়েছে ওরা, একজনের গলা শুনতে পেল রবিন।
স্কুলে নতুন ভর্তি হয়েছে, জবাব দিল ফ্রাঙ্কেনস্টাইন। রবিন না কি যেন নাম।
হাঁচড়েপাঁচড়ে বোপ থেকে উঠে পড়ল রবিন। গা চুলকোচ্ছে। দুএক জায়গায় ছড়েও গেছে। দুঃখে-অপমানে জল এসে গেছে চোখে। একবার চিন্তা করল বাড়ি ফিরে যাবে। কিন্তু বাবা-মা ওর এই দশা দেখলে কষ্ট পাবেন ভেবে নাকচ করে দিল। চিন্তাটা। না, সিদ্ধান্ত নিল রবিন। সহজে হাল ছেড়ে দেয়ার পাত্র আমি নই। সে
আবার হাঁটতে শুরু করল স্কুলের উদ্দেশে।
যাবার পথে একটা বাড়ির বাগানে একটা নেকড়ে মানব, দুজন ফুটবল খেলোয়াড় আর এক এক-চোখা দানবকে লাফালাফি করতে দেখল রবিন। খুব মজা করছে ওরা। ওদের হাতের ব্যাগগুলো ফুলো ফুলো। বোঝা যায়, উপহারে ভর্তি। ওদেরকে ডাক দেবে রবিন, এমন সময় একজন চিনে ফেলল ওকে। হেঁকে বলল, ওই দ্যাখ রবিন!…কী ব্যাপার রবিন? তোমার হ্যালোউইন ড্রেস কোথায়?
ওর বোধহয় হ্যালোউইন ড্রেস কেনার পয়সা নেই, মন্তব্য করল আরেকজন। শুনে অন্যরা হেসে উঠল হো হো করে। রবিনের লাগল খুব। কিছু একটা বলতে গিয়েও বলল না। মুখ নিচু করে চলে এল ওখান থেকে।
আবার হাঁটতে শুরু করেছে রবিন। ভাবছে লোকের বাড়িতে কড়া নেড়ে ঘাউ করে চিৎকার করে তাদেরকে চমকে দিলে কেমন হয়? কিন্তু সবাই কি জানে আজ হ্যালোউইন ডে? দেখি না একবার চেষ্টা করে। ভাবল রবিন। সে একটা বাড়ির কলিংবেল টিপল। দরজা খুলে দিলেন এক বয়সী ভদ্রলোক। তিনি প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালেন রবিনের দিকে। রবিন কিছু বলতে যাবার আগেই ভদ্রলোকের পেছন থেকে বেরিয়ে এল ছোট একটা ছেলে। রাক্ষস সেজেছে সে। রবিনকে দেখে নখ বাঁকিয়ে হাউ মাউ খাউ বলে উঠল। রবিন ওকে দেখে হাসল। ছেলেটা ভদ্রলোকের দিকে টলটলে দুই চোখ মেলে তাকিয়ে বলল, বাবা, ওকি জানে না আজ হ্যালোউইন ডে?