হঠাৎ পেছন থেকে হামলা করে বসল বাতাস। যেন ধাক্কা মেরে ওকে ফেলে দেবে লেকের মাঝখানে। ডুবিয়ে মারবে। ভয় পেল হ্যাল। তবে একই সাথে উল্লাস বোধও করছে। কারণ মূর্তিমান আতঙ্ক বানরটার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া গেছে। তার যা হবার হবে, কিন্তু শয়তানটা ডেনিশ বা পেটির কোন ক্ষতি করতে পারবে না। দূর হয়েছে হারামজাদা। এতক্ষণে ক্রিস্টাল লেকের পাতালে পৌঁছে গেছে। দূর হয়েছে চিরদিনের জন্যে।
বৈঠা বাইছে হ্যাল। আবার কাঠ ফাটার শব্দ। নৌকায় তিন ইঞ্চি পানি জমে গেছে। হঠাৎ খুবই জোরে একটা শব্দ হলো। সাথে সাথে একটা সিট ভেঙে দুটুকরো হয়ে গেল। কিন্তু হাল ছেড়ে দেয়ার পাত্র নয় হ্যাল। বৈঠা বেয়ে যেতে লাগল সে। তাকে তীরে পৌছুতেই হবে। মুখ হাঁ করে শ্বাস করছে। ঘামে ভেজা চুল বাতাসে উড়ছে।
এবার ঠিক নৌকার তলা থেকে কড়াৎ করে শব্দ হলো। আঁকাবাঁকা ফাটল সৃষ্টি হলো ওখানে। বেগে পানি ঢুকল নৌকায়। নিমিষে ডুবিয়ে দিল হ্যালের গোড়ালি। তারপর হাঁটুর নিচের অংশ। হ্যাল, বৈঠা বাইছে তো বাইছেই। তবে গতি আগের চেয়ে মন্থর।
আরেকটা তক্তা আলগা হয়ে গেল। নৌকার ফাটল দ্রুত বেড়েই চলেছে। সেই সাথে হড়হড় করে ঢুকছে পানি। ইতিমধ্যে একটা বৈঠা হারিয়ে ফেলেছে হ্যাল। দাঁড়িয়ে পড়েছে ও। নৌকাটা প্রবলভাবে এপাশ-ওপাশ দুলছে। ধাক্কার চোটে সিটের মধ্যে ধপ করে পড়ে গেল হ্যাল।
একটু পরে বসার আসনটাও ভেঙে গেল। চিৎ হয়ে পানিতে পড়ে গেল হাল। ঠাণ্ডা পানিতে শির শির করে উঠল গা। হাঁচড়েপাঁচড়ে উঠে বসার চেষ্টা করল। প্রার্থনা করল পেটি যেন না দেখে তার বাপ তার চোখের সামনে ডুবে মরছে।
এক মুহূর্ত পরে প্রচণ্ড আরেকটা ঢেউ দুটুকরো করে ফেলল নৌকাটাকে। ছিটকে লেকে পড়ে গেল হ্যাল। প্রাণপণে তীর লক্ষ্য করে সাতার কাটতে শুরু করল। এত জোরে জীবনে সাঁতার কাটেনি হ্যাল। মিনিট খানেক পরে কোমর সমান পানিতে চলে এল সে। তীর থেকে মাত্র পাঁচ গজ দূরে।
পেটি ছুটে গেল বাবার কাছে। কাঁদছে, চিৎকার করছে, হাসছে। হ্যাল এগোল ছেলের দিকে। হঠাৎ একটা ঢেউ এসে ওকে চুবুনি দিয়ে গেল। চুবুনি খেল পেটিও। একমুহূর্ত পরে মিলন ঘটল বাপ-ছেলের। পরস্পরকে ধরে ফেলল ওরা।
বেদম হাঁপাচ্ছে হ্যাল, বুকের মধ্যে জড়িয়ে রেখেছে ছেলেকে। পেটিও হাঁপাচ্ছে।
বাবা? ওটা সত্যি দূর হয়েছে? বানরটা?
হ্যাঁ। দূর হয়েছে।
নৌকাটাকে দেখলাম টুকরো হয়ে যেতে…ঠিক তোমার পাশে টুকরো হয়ে ছড়িয়ে গেল…
লেকের দিকে তাকাল হ্যাল। তক্তাগুলো ভাসছে পানিতে। আশ্চর্য, লেকের পানিতে ঢেউয়ের উন্মত্ততা থেমে গেছে। আকাশের দিকে মুখ তুলে চাইল হ্যাল। আকাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সাদা মেঘ। কালো মেঘের চিহ্নও নেই কোথাও।
তুমি মেঘ দেখেছিলে? ফিসফিস করল পেটি। কি ভয়ানক কালো মেঘ। চোখের নিমিষে আকাশ ছেয়ে ফেলল। আমি তোমাকে ফিরে আসার জন্য কত ডাকাডাকি করলাম। কিন্তু তুমি শুনলেই না। কান্নায় গলা বুজে এল পেটির।
এখন সব ঠিক হয়ে গেছে, সোনা। ওকে জড়িয়ে ধরিয়ে থাকল হ্যাল। আর ভয় নেই।
তোমার খুব সাহস, বাবা। হ্যালের দিকে তাকাল পেটি।
তাই? মুচকি হাসল হ্যাল। যা, বোট হাউসে তোয়ালে আছে। গা মুছে নে।
আমরা ঘটনাটা মাকে বলব না, বাবা?
হাসল হ্যাল। জানি না, বাপ। ও নিয়ে পরে ভাবা যাবে। এখন চল।
ছেলেকে নিয়ে বোট হাউসের দিকে পা বাড়াল হ্যাল।
ব্রিজটন নিউজ থেকে ২৪ অক্টোবর, ১৯৮০
মরা মাছ রহস্য
গত হপ্তায় কাসকোর ক্রিস্টাল লেকে হঠাৎ শতশত মাছ পেট ফুলে মরে ভেসে উঠতে দেখা যায়। প্রায় সব ধরনের মাছই মরে ভেসে উঠেছে। মৎস্য কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, হঠাৎ মাছ কেন মরে ভেসে উঠল সেটার কারণ তাদের অজানা। তবে কর্তৃপক্ষ জেলে এবং মহিলাদের নিষেধ করেছেন ক্রিস্টাল লেকের মাছ আপাতত না। ধরতে। মরা মাছ রহস্য উদ্ঘাটনের তদন্ত চলছে…
[মূল: স্টিফেন কিং-এর দ্য মাঙ্কি]
মুখোশের আড়ালে
একাকীতু যেন দাঁত মুখ খিচিয়ে গিলতে আসে রবিনকে। ক্লাসমেটদের সাথে বন্ধুত্ব করতে চায় ও। কিন্তু গ্রীন হেরাল্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের ছেলেগুলো যেন কেমন! মিশতেই চায় না রবিনের সঙ্গে। ওকে বহিরাগতদের মত দেখে। তুচ্ছ তাচ্ছিল্য। করে। ওকে খেলতে ডাকে না, কোন অনুষ্ঠানে দাওয়াত করে না। একরকম একঘরেই করে রেখেছে ওরা রবিনকে।
কিন্তু রবিনের দোষ কী? রবিন তো নিজের কোন ক্রটি খুঁজে পায় না। ও সবার। সাথে মিশতে চায়, বন্ধু হতে চায়। ক্লাসমেটরা দূরে দূরে সরে থাকলে ওর কী করার আছে? রবিন ভেবেছিল অন্তত আজকের দিনটা ওরা ওকে কাছে ডেকে নেবে। আজ বিশেষ একটি দিন। হ্যালোউইন ডে। আজ নানা ভূতুড়ে মুখোশ পরে মজা করবে। রবিনের ক্লাসমেটরা-জনি, রিন্টু, লিটন, আবিদ, জেসি সবাই। ওদের আনন্দের ভাগীদার হতে চেয়েছিল রবিন। আগ্রহ নিয়ে জানতে চেয়েছিল দলটার সঙ্গে যোগ দিতে পারবে কিনা। দেখি বলে ওকে পাশ কাটিয়ে গেছে জনি। জেসি শুধু মুচকি হেসেছে। আবিদ তো মুখের ওপর না-ই বলে দিল! আর লিটন খ্যাক খ্যাক করে। উঠেছে, আমাকে বিরক্ত কোরো না তো!
ভীষণ অপমানিত হয়ে ফিরে আসতে হয়েছে রবিনকে। মন খারাপ করে বাড়ির রাস্তা ধরেছে। স্কুল থেকে খুব বেশি দূরে নয় বাসা। হেঁটেই যাওয়া যায়। ঢাকায়। নতুন এসেছে রবিনরা। এর আগে খুলনা ছিল। ওর বাবা-মা সরকারী চাকুরে। দুজনেই বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা। তবে বাবা বেশিদিন এক জায়গায় থাকতে পছন্দ করেন না। ফলে প্রায় প্রতি বছরই স্কুল বদলাতে হয় রবিনকে। ওর প্রথম প্রথম খারাপ লাগত। এখন লাগে না। বরং নতুন জায়গা, নতুন মানুষ দেখতে ভালই লাগে। বাবা-মা তেল, জল, উদ্ভিদ, প্রাণীদের স্যাম্পল ইত্যাদি নিয়ে কাজ করেন। বর্তমানে এ সবেরই কিছু একটা নিয়ে গবেষণা করছেন ওঁরা। তবে রবিন ঠিক জানে না। বাবা-মার কাজে ওর নাক গলানো কঠোরভাবে নিষেধ।