দেশলাই হবে, ভাই? জিজ্ঞেস করল মিশরের পুরোহিত!
এই প্রথম হাসলাম আমি, মনে পড়েছে এই মুহূর্তে কোথায় আছি। শালার মদ আমাকে ধরেছিল খুব। কিসব উদ্ভট চিন্তা করেছি এতক্ষশ। দ্রুত মাথাটা পরিষ্কার হয়ে এল। লাইটার বাড়িয়ে দিলাম লোকটার দিকে। আগুন জ্বালল সে, শিখার আলোয় কৌতূহল নিয়ে তাকাল আমার দিকে।
লোকটার বাদামী চোখ দেখে মনে হলো যেন চিনতে পেরেছে আমাকে। অবাক হয়ে গেলাম ওর মুখে আমার নাম শুনে। মাথা ঝাঁকালাম সায় দেয়ার ভঙ্গিতে।
কি আশ্চর্য! মুখ টিপে হাসল সে। আপনিই তাহলে সেই স্বনামধন্য লেখক? আপনার তো মস্ত ভক্ত আমি, সাহেব। সম্প্রতি প্রকাশিত বইটাও পড়ে ফেলেছি। কিন্তু বুঝলাম না নিউ অরলিন্সে কি করছেন আপনি।
অল্প কথায় ব্যাখ্যা করলাম ওকে। আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল সে।
পরিচিত হয়ে সৌভাগ্যবান মনে করছি নিজেকে। আমার নাম ভ্যানিং-হেনরিকাস ভ্যানিং। আমিও আপনার মতই প্রেতশাস্ত্রে ভীষণ আগ্রহী।
আলাপে ওস্তাদ লোক ভ্যানিং। জমিয়ে ফেলল কয়েক মিনিটের মধ্যে। অথবা বলা যায় সে একভাবে বকবক করে গেল আর আমি শুধু শ্রোতার ভূমিকা পালন করলাম। জানলাম মি. ভ্যানিং প্রচুর সহায়-সম্পত্তির মালিক, ধর্মীয় পুরাণ বা শাস্ত্রের ওপর তার সগ্রহ যেমন বিস্তর, পড়াশোনাও করেছে প্রচুর। বিশেষ করে মিশরের ওপর তার আগ্রহ সীমাহীন। কথায় কথায় ভ্যানিং জানাল ওদের একটা দল আছে যারা অধিবিদ্যা নিয়ে প্রায়ই গঠনমূলক আলোচনায় বসে, এ নিয়ে গবেষণাও করে। এ ব্যাপারটা আমাকেও আগ্রহী করে তুলতে পারে, এমন একটা আভাসও দিল ভ্যানিং।
হঠাৎ যেন আবেগে উথলে উঠল সে, আমার হাতদুটো চেপে ধরে ব্যগ্র কণ্ঠে জানতে চাইল, আজ রাতে কি করছেন?
জানালাম কাজ-কাম করতে ভাল লাগছে না। তাই দিবা-স্বপ্ন দেখছি। হাসল সে।
বেশ! আমি খানিক আগে ডিনার সেরেছি। বাড়ি যাচ্ছিলাম কয়েকজন অতিথিকে অভ্যর্থনা জানাতে। এরা আমার সেই ছোট্ট দল-যাদের কথা একটু আগেই বলেছি আপনাকে-ওদের নিয়ে একটা পার্টির ব্যবস্থা করেছি ওখানে। যাবেন নাকি? কস্টিউম পার্টি। মজা পাবেন।
কিন্তু আমার পরনে তো কোন কস্টিউম নেই, বললাম আমি।
তাতে কিছু হবে না। আপনি এমনিই পাটি উপভোগ করতে পারবেন। একেবারে আলাদা জিনিস। চলুন তাহলে।
ওকে অনুসরণের ইশারা করে আগে আগে হাঁটতে শুরু করল হেনরিকাস ভ্যানিং। শেষ পর্যন্ত কৌতূহলের জয় হলো। তাই সদ্য পরিচিত লোকটার পেছন পেছন এগোলাম আমি।
হাঁটতে হাঁটতে বাকপটু ভ্যানিং তার বন্ধুদের সম্পর্কে বলতে শুরু করল। ওরা যে ক্লাব করেছে তার নাম দিয়েছে কফিন ক্লাব। চিত্রকলা, সাহিত্য আর সঙ্গীত নিয়েই দলের সদস্যদের সময় কাটে। তবে তাদের আলোচনার বিষয় শিল্পকলার এই তিনটে মাধ্যমের অন্ধকার দিকগুলো।
ভ্যানিং জানান, আজ রাতে দলটা অত, নিজস্ব সাজে সাজবে। কারণ আজ তাদের এক বিশেষ উৎসবের দিন। ডাকাত, ক্লাউন, জলদস্যু ইত্যাদি গতানুগতিক সাজ আজকের দিনে মোটেই চলবে না। অতি প্রাকৃত সাজে সাজতে হবে সবাইকে। মনে মনে চিন্তা করলাম ওরা নিশ্চয়ই ওয়্যারউলফ, ভ্যাম্পায়ার, পুরোহিত, কালো জাদুকর ইত্যাদির রূপ ধরবে। এসব ব্যাপারে আমার আগ্রহও আছে। কারণ অকাল্ট শাস্ত্রের ওপর পড়াশোনা করে নিজের অজান্তে এসব আধি ভৌতিক ব্যাপারগুলোর প্রতি কবে ঝুকে পড়েছি এখন আর তা মনে নেই। ভ্যানিং-এর সাথে যেতে যেতে নতুন কিছু দেখার আশায় মনে মনে বেশ উৎসাহী হয়ে উঠছিলাম।
হেনরিকাস ভ্যানিং-এর সাথে কথা বলতে এমন মশগুল ছিলাম যে, কোথেকে। কোথায় এসে পড়েছি জানি না। শেষমেশ আমাদের গতি শ্লথ হয়ে এল গুলুচ্ছাদিত লম্বা, সরু একটি রাস্তার মুখে এসে। রাস্তাটার শেষ মাথা গিয়ে ঠেকেছে যেখানে, সেখানে দাড়িয়ে আছে আলোকিত এক রাজ প্রাসাদ।
ভ্যানিং-এর বাকচাতুরীতে মুগ্ধ আমি প্রাসাদের চারপাশে ভাল করে চোখ বোলালাম না পর্যন্ত, দরজা খোলা ছিল, সেই দরজা দিয়ে সোজা ভেতরে ঢুকে গেলাম আমরা-প্রবেশ করলাম নির্জলা এক আতঙ্কের জগতে।
বিশাল বাড়িটার সব জায়গায় আলো জ্বলছে। রক্তের মত টকটকে লাল আলো।
আমরা দাঁড়িয়ে আছি একটা হলওয়েতে; নরকের মত হলওয়ে। লাল আলোর ছুরি যেন আয়না ঘেরা দেয়ালের ওপরের অংশ কেটে বেরুচ্ছে। সিঁদুররঙা ঝালর টানানো ভেতরের প্রবেশ পথে, ফায়ারপ্লেসের ধিকি ধিকি জ্বলা আগুনের শিখার ছায়া তিরতির করে কাঁপছে গাঢ় লাল সিলিং-এ, যেন আগুন ধরে গেছে। খোদ শয়তানের মত চেহারার এক বাটলার আমার হ্যাটটা নিয়ে হাতে ধরিয়ে দিল চেরী ব্রান্ডি বোঝাই সুদৃশ্য পানপাত্র।
লাল ঘরে একা আমি, ভ্যানিং ফিরল আমার দিকে, ওর হাতেও একটা গ্লাস।
পছন্দ হয়েছে? জিজ্ঞেস করল সে। অতিথিদের মনোরঞ্জনের জন্য ঘরটা এভাবে সাজিয়েছি। পো-র গল্প থেকে আইডিয়াটা সামান্য ধার করা।
লোকটার খেয়ালী স্বভাব আমাকে বেশ অবাক করল। কি যেন করতে চাইছে ও। মিশরের পুরোহিতের ছদ্মবেশধারীর হাতে খালি গ্লাসটা দেয়ার সময় আমি কেন জানি সামান্য শিউরে উঠলাম।
এখন চলুন-অতিথিদের সাথে দেখা করে আসি। একটা ট্যাপেস্ট্রি একপাশে ঠেলে সরাল ভ্যানিং, আমরা ডানদিকে গুহার মত একটা ঘরে ঢুকলাম।
এ ঘরের দেয়ালগুলো সব সবুজ আর কালো পর্দায় ঢাকা; কুলুঙ্গির মোমবাতি শুধু আলোকিত করে রেখেছে ঘরটাকে। আসবাবপত্রগুলো আধুনিকই বলা যায়, তবে বৈচিত্র্যহীন। আমন্ত্রিত অতিথিদের ভিড়ের দিকে যখন তাকালাম, মনে হলো বুঝি স্বপ্ন দেখছি।