জবাব দিল না হল। ব্যাগটা মাটিতে নামিয়ে রেখে বলল, এটা ধরবি না।
পকেট হাতড়ে চাবির গোছা বের করল হ্যাল। বিল দিয়েছে। গোছায় অ্যাডহেসিভ টেপ লাগানো। তাতে লেখা বোট হাউস।
দিনটি পরিষ্কার, ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। আকাশ ঝকমকে নীল। লেকের পাড়ের গাছগুলোর ডাল এবং পাতা বাতাস পেয়ে নড়ছে। যেন কথা বলছে বাতাসের সঙ্গে।
তালা খুলে বোট হাউসে ঢুকল হ্যাল। স্যাতসেঁতে একটা গন্ধ ঝাপটা মারল নাকে। উইল চাচার রো বোটটা আগের মতই পড়ে আছে। বৈঠা জোড়া ঝকঝকে। যেন গতকালই নৌকা বেয়েছেন চাচা। এই নৌকায় চড়ে সে বহুবার চাচার সাথে লেকে গিয়েছে মাছ ধরতে। তবে বিলকে নিয়ে এক সঙ্গে যাওয়া হয়নি। নৌকাটা ছোট। তিনজনের জায়গা হয় না। বিল চাচার সাথে আলাদাভাবে গেছে। র্যাম্প ধরে নৌকাটাকে টেনে আনল হ্যাল। ভাসিয়ে দিল ক্রিস্টাল লেকে। খুব গভীর লেক। একশো ফুটেরও বেশি। চাচা কখনও মাঝ লেকে যাননি মাছ ধরতে। লেকের নীলচে-কালো পানি এখন স্থির।
পেটি জানতে চাইল, আমাকে নেবে না; বাবা?
হ্যাল বলল, আজ নয়। পরে। বলে উঠে পড়ল সে নৌকায়।
ঠিক তখন তার রক্ত হিম করে দিয়ে বেজে উঠল ঢোল-ডিম ডিমা ডিম ডিম। ব্যাগের মধ্যে বসে ঢোল বাজাচ্ছে বানর। কাঁপতে কাঁপতে ব্যাগের চেইন খুলে ফেলল হ্যাল। বানরটা বিদ্রুপের ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। হাসছে। ঢোল বাজানো বন্ধ হয়ে গেল। হাসি হাসি মুখটা যেন বলছে এবার কার পালা, হ্যাল? তোমার না পেটির?
কুত্তার বাচ্চা! দাঁতে দাঁত চাপল হ্যাল। দাঁড়া, তোর ব্যবস্থা করছি।
ব্যাগের চেইন আবার বন্ধ করে ফেলল হ্যাল। তাকাল তীরের দিকে। পেটি দাঁড়িয়ে আছে তীরে। হাত নাড়ছে। হাত নেড়ে প্রত্যুত্তর দিল হ্যাল।
সূর্য এখন মাথার ওপর। ঘাড়ে বিদ্ধ করছে সূর্যতাপ। ঘামতে শুরু করেছে হ্যাল। ফ্লাইট ব্যাগটার দিকে এক পলক তাকাল। মনে হলো…মনে হলো ব্যাগটা যেন ফুলে উঠেছে। ব্যাগ থেকে নজর ফিরিয়ে নিল হ্যাল। দ্রুত বাইতে শুরু করল বৈঠা।
বাতাসটা ঠাণ্ডা। শুকিয়ে ফেলল ওর ঘাম, শীতল হয়ে এল গা। কিছুক্ষণ আগেও লেকে ঢেউ ছিল না। এখন বাতাসের সাথে লেকে ঢেউ উঠতে শুরু করেছে। লেকের তীর থেকে পেটি চিৎকার করে কিছু একটা বলল তার বাপকে। কিন্তু বাতাসের শোঁ শোঁ আওয়াজে শুনতে পেল না হ্যাল 1 কিছু একটা দেখতে ইশারা করছে পেটি। বুঝতে পারল না হ্যাল। আকাশের দিকে মুখ তুলে চাইল। আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে। অথচ একটু আগেও ঝকমক করছিল আকাশ। লেকের ঢেউও বেড়ে গেছে বাতাসের বেগের সাথে। নৌকার গায়ে সাদা ফেনা নিয়ে ছুটে এসে ধাক্কা খাচ্ছে ঢেউ। দুলে দুলে উঠছে নৌকা।
পেটির দিকে তাকাল হ্যাল। আকাশের দিকে আঙুল তুলে কি যেন দেখাচ্ছে ছেলেটা। ওর কাছ থেকে অনেক দূরে চলে এসেছে হ্যাল। চিৎকার অস্পষ্ট শোনাচ্ছে।
আকাশ খুব দ্রুত ঢেকে যেতে শুরু করল কালো মেঘে। সেই সাথে বেড়ে চলল ঢেউয়ের আকার। বিশাল বিশাল ঢেউ ছুটে এল নৌকার দিকে। হ্যালের মনে হলো ঢেউয়ের সাথে একটা ছায়া দেখতে পেয়েছে সে। খুব পরিচিত একটা ছায়া। ছুটে আসছে তার দিকে। অনেক কষ্টে গলা ঠেলে উঠে আসা চিৎকারটাকে গিলে ফেলল হাল।
সূর্য ঢাকা পড়ে গেছে মেঘের আড়ালে। কালো মেঘের প্রকাণ্ড ছায়া গ্রাস করল নৌকা। সাথে সাথে ব্যাগের ভেতর থেকে ভেসে এল ঢোলের শব্দ-ডিম ডিমা ডিম ডিম, এক ঘেয়ে বাজনাটা যেন বলে চলল: এবার পেয়েছি তোমাকে, হ্যাল। লেকের গভীরতম অংশে চলে এসেছ তুমি। এবার তোমার পালা, তোমার পালা
বৈঠা জোড়া নৌকায় তুলে চট করে ফ্লাইট ব্যাগটা তুলে নিল হ্যাল। ঢোল বেজেই চলেছে। আওয়াজ আরও জোরাল।
এখানে কুত্তার বাচ্চা! চিৎকার করে উঠল হ্যাল। এখানেই তোর মরণ!
ভারী পাথর বোঝাই ব্যাগটা পানিতে ছুঁড়ে ফেলল সে।
দ্রুত ডুবতে শুরু করল ব্যাগ। ডুবছে, হ্যাল দেখল ব্যাগের কোণা নড়ছে। তার মনে হলো অনন্তকাল ধরে সে ঢোলের বাজনা শুনছে। এক মুহূর্তের জন্যে মনে হলো লেকের খলবলে কালো পানি যেন পরিষ্কার হয়ে গেল। সে ওখানে দেখতে পেল অ্যামস বুলিগানের স্টুডবেকারকে, সে এই লেকে মাছ ধরতে এসে ডুবে মরেছে। এর গল্প উইল চাচা অনেক বলেছে হ্যালকে। হাল ওর মাকেও দেখতে পেল পানির মধ্যে। কংকাল। দাঁত বের করে হাসছেন? উইল চাচা এবং ইডা চাচী। মার পাশে, ঢেউয়ের তালে দোল খাচ্ছে। ব্যাগ পড়ছে, বুদ্বুদ উঠছে ওপরে। সেই সাথে শব্দ আসছে ডিম ডিমা ডিম ডিম।
পাগলের মত বৈঠা বাইতে শুরু করল হ্যাল। ঠিক সেই সময় পিস্তলের গুলির মত আওয়াজ হলো দুই পায়ের মাঝখানে। ফেটে গেছে তক্তা। ভাঙা তক্তার মাঝ দিয়ে হুড়হুড়িয়ে পানি ঢুকতে শুরু করল। নৌকাটা বহু পুরানো, কাঠ হয়তো পচে গেছিল, তাই ফাটল ধরেছে তক্তায়। কিন্তু নৌকা পানিতে নামানোর সময় কোন। ফাটল বা ছিদ্র চোখে পড়েনি হ্যালের। হ্যাল নৌকা বাইতে লাগল।
হ্যাল মোটামুটি সাঁতার জানে। কিন্তু নৌকা ডুবে গেলে খুঁসে ওঠা এই লেকে সাঁতার কেটে আদৌ লাভ হবে কিনা জানে না।
বিশ সেকেন্ড পাগলের মত বৈঠা বাইবার পরে আবার পিস্তলের গুলির আওয়াজ হলো। আবার দুটো তক্তা ফেটে গেছে। আরও পানি ঢুকতে শুরু করল। ভিজিয়ে দিল হ্যালের জুতো। ধাতব শব্দ হতে বুঝতে পারল পেরেক টেরেকগুলোও ছুটে যাচ্ছে নৌকার গা থেকে।