বেগে বানরটার দিকে ছুটল হ্যাল। ওকে পা দিয়ে মাড়িয়ে থেঁতলে দেবে, গায়ের ওপর উঠে লাফাবে যতক্ষণ পর্যন্ত না ওটার সমস্ত যন্ত্রপাতি শরীর থেকে ছুটে পড়ে, ভয়ংকর চোখজোড়া গড়াগড়ি যায় মেঝেতে। কিন্তু বানরটার সামনে আসতেই ওটা আবার সচল হয়ে উঠল। আবার আস্তে আস্তে বাজতে শুরু করল ঢোল। ভয়টা আবার ফিরে এল হ্যালের মনে। বানরটা তখন দাত বের করে হাসছে। যেন জেনে ফেলেছে হ্যালের কিসে ভয়। কিন্তু হালের রাগও হচ্ছিল প্রচণ্ড ভয়টাকে পাত্তা না দিয়ে সে পুতুলটাকে তুলে নিল হাতে। বুড়ো আঙুল আর তর্জনী দিয়ে বানরটার একটা হাত ধরল। হ্যালের চেহারা বিকৃত যেন একটা লাশ ধরে আছে। ব্যাক ক্লজিটের ছোট দরজাটা হাতড়ে খুলে ফেলল। আলো জ্বালল। বানরটা মুচকি হাসছে ওর দিকে তাকিয়ে। হ্যাল স্টোরেজ এলাকার মাঝ দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে এগোল। চারপাশে প্রচুর বাক্স। একটার ওপর আরেকটা উঁই করে রাখা। পুরানো কেমিকেল, কাপড় আর স্যুভেনিরের গন্ধ ভেসে এল নাকে। হ্যাল ভাবছে: বানরটা যদি এখন আবার ঢোল বাজাতে শুরু করে আমি নির্ঘাত চিৎকার করে উঠব। আর আমি যদি চিল্কার করি তাহলে ওটা আরও বেশি করে হাসবে। তাহলে আমি পাগল হয়ে যাব। লোকে আমাকে যখন এখানে খুজে পাবে দেখবে পাগলের মত হাসছি আমি। আমি পাগল হয়ে যাব! ওহ, ঈশ্বর, দয়া করো যীশু, আমাকে পাগল হতে দিয়ো না–
ক্লজিটের দূর প্রান্তে চলে এল হ্যাল, দুটো বাক্সের একটা সরাতেই র্যালস্টনপূরিনার বাক্সটা চোখে পড়ল। ওটার ভেতর সেকাল বানরটাকে। তারপর ঠেলে সরিয়ে দিল কোণার দিকে। পিছিয়ে এল হাল। হাপাচ্ছে, ভয় পাচ্ছে কখন আবার বেজে ওঠে ঢোল। ঢোল বাজলেই হয়তো বাক্স খুঁড়ে বেরিয়ে আসবে বানর, লাফিয়ে পড়বে হ্যালের ওপর।
কিন্তু এসব কিছুই ঘটল না। হ্যাল বাতি নেভাল। বন্ধ করে দিল ক্লজিটের দজা , এখনও হাঁপাচ্ছে। তবে আগের চেয়ে ভাল লাগছে। ক্লান্ত পায়ে নেমে এল নিচে। একটা খালি ব্যাগ জোগাড় করল। তারপর গা কাঁচের টুকরো তুলতে শুরু কবুল মেঝে থেকে। তোয়ালে দিয়ে পরিষ্কার করল মেয়ের দুধ। শেষে অপেক্ষা করতে লাগল মা আর ভাইয়ের জন্য।
মা এলেন আগে। জিজ্ঞেস করলেন, বিল কোথায়? হ্যাল জানাল বিল প্যাট্রল বয় মিটিং-এ গেছে। তবে ওর ফিরে আসার কথা আরও আধাঘণ্টা আগে।
হ্যালের শুকনো, নিপ্রাণ কণ্ঠ শুনে বিচলিত বোধ করলেন মা। উদ্বিগ্ন চোখে চাইলেন ছেলের দিকে, কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছেন, ঠিক তখন খুলে গেল সদর দরজা। ভেতরে ঢুকল বিল। কিন্তু ও যেন বিল নয়। বিলের ভূত! বিষণ্ণ, নীরব। কি হয়েছে? চেঁচিয়ে উঠলে মিসেস শেলবার্ন। কি হয়েছে, বিল?
কাঁদতে শুরু করল বিল। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে চলল তার গল্প।
বিল স্কুলের মিটিং শেষে তার বন্ধু চার্লি সিলভার ম্যানকে নিয়ে বাড়ি ফিরছিল। কিন্তু ব্যস্ত রাস্তা ব্রুক স্ট্রীট কর্নারের মোড় পার হবার সময় একটা দ্রুতগামী গাড়ি চার্লিকে চাপা দিয়ে চলে যায়।
এবার তারস্বরে কান্না শুরু করে দিল বিল, বেড়ে গেল ফোঁপানি। মা জড়িয়ে ধরলেন ওকে। সান্ত্বনা দিচ্ছেন। কেঁদে ফেলল হ্যালও। তবে এটা তার স্বস্তির কান্না।
চার্লির মৃত্যু গভীর দাগ কেটে গেল বিলের মনে। সে রীতিমত দুঃস্বপ্ন দেখতে শুরু করল। চার্লির হন্তারক ড্রাইভার ধরা পড়ল। লোকটা বেহেড মাতাল হয়ে গাড়ি চালাচ্ছিল। তবে কাস্টডিতে নেয়ার কিছুদিন পরেই হার্ট-অ্যাটাকে মারা গেল সে।
হ্যাল এদিকে বানরটার কথা প্রায় ভুলেই বসেছিল। কিংবা বলা যায় গোটা ব্যাপারটা সে ধরে নিয়েছিল স্রেফ একটা দুঃস্বপ্ন হিসেবে। কিন্তু বানরের স্মৃতি মন থেকে মুছে ফেলতে পারল না সে তার মার মৃত্যুর কারণে।
একদিন বিকেলে হ্যাল স্কুল থেকে ফিরে এসে দেখে তার মা মরে গেছে। আর বানরটা আবার ফিরে গেছে শেলফে, ঢোল বাজার অপেক্ষায়, মুখে সেই ভয়ংকর মুচকি হাসি।
হ্যাল হাত বাড়িয়ে তুলে নিল বানরটাকে। ওটা মোচড় খেল মুঠোর মধ্যে। যেন জ্যান্ত। গুঙিয়ে উঠল হ্যাল। আঙুল ঢুকিয়ে দিল বানরের চোখের মধ্যে। তারপর দেয়ালে ওটাকে বারবার আছাড় মারল। শেষে বাথরুমে ঢুকে হড় হড় করে বমি করে দিল হ্যাল।
জানা যায়, সেদিন বিকেলে মিসেস শেলবার্ন মারা গিয়েছিলেন মস্তিষ্কে রক্ত জমাট বেঁধে যাবার কারণে। ওয়াটার কুলারের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি হাতে এক গ্লাস পানি নিয়ে। হঠাৎ ঝকি খায় তার শরীর, যেন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। হাঁটু ভেঙে পড়ে যান মিসেস শেলবার্ন। হাত থেকে ছিটকে পড়ে যায় গ্লাস। ডাক্তার বলেছেন গ্লাসের পানি মিসেস শেলবার্নের গা ভিজিয়ে দেয়ার আগেই তিনি মারা গেছেন।
দুটো রাত ভয়াবহ কেটেছে দুই ভাইয়ের। ওই দুই রাত ওদের সাথে ছিলেন প্রতিবেশী মিসেস স্টাবি। দুইদিন পরে ইডা চাচী এসে ওদেরকে নিয়ে যান নিজের বাড়িতে।
মার মৃত্যু দৃশ্য দুঃস্বপ্নের মত অনেকদিন তাড়া করে ফিরেছে হ্যালকে। বড় ভাই বিল সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করেছে ছোট ভাইকে। কি হ্যাল সবসময় অপরাধ বোধে ভুগেছে। মার মৃত্যুর জন্যে নিজেকে দায়ী বলে মনে হত তার। সেদিন বিকেলে স্কুল থেকে ফেরার পরে বানরটাকে লাথি মারা উচিত হয়নি। বানরটা তার প্রতিশোধ নিয়েছে।