বানরটাকে হ্যাল খুঁজে পায় ব্যাক ক্লজিটে। সেটা ছিল মার্চের এক ঠাণ্ডা, বিষণ্ণ দিন। বিউল্লাহ্ বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে গেছে, হ্যাল গেল ক্লজিটে, তার বাবার ফেলে দেয়া জিনিসপত্র দেখতে।
দোতলার বাম দিকে, বাড়তি জায়গাটুকুতে ছিল ক্লজিটটা। ওটার প্রতি দারুণ আকর্ষণ অনুভব করত হাল। পুরানো ক্লজিটটাকে কখনও ভার্নিশ করা হয়নি। ভেতরে রাজ্যের হাবিজাবি জিনিস। হ্যাল তার ভাইকে নিয়ে সুযোগ পেলে এখানে চলে আসে। বাক্সপেটরা খুঁজে দেখে, জিনিসপত্র উল্টে দেখে। প্রতিটি জিনিসের
স্পর্শে শিহরিত হয়ে ওঠে। তারপর যেখানকার জিনিস সেখানে আবার গুছিয়ে রেখে দেয়। মাঝে মাঝে হ্যাল এবং বিল ভাবে যদি তাদের হারানো বাবার সন্ধান পাওয়া যেত তাহলে কতই না ভাল হত।
সেদিন ক্লজিটে ঢুকেছে হ্যাল, একটা বাক্স একপাশে সরিয়ে রাখতেই ওটার পেছনে আরেকটা বাক্স চোখে পড়ল। একটা র্যালস্টন-পুরিনা কার্টন। ওটার ওপর দিয়ে এক জোড়া চকচকে চোখ জুলজুলে দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ভয়ানক চমকে গেল হ্যাল, উত্তেজনায় ধড়ফড় করতে লাগল বুক। যেন মৃত একটা পিগমি আবিষ্কার করে ফেলেছে। এক মুহূর্ত পরেই বুঝতে পারল ওটা একটা খেলনা।
এক পা সামনে বাড়াল হ্যাল, সাবধানে জিনিসটা তুলে নিল বাক্স থেকে। ওটা হাসছে হ্যালের দিকে তাকিয়ে, হলদে আলোয় দাঁতগুলো বিকট দেখাল। ঢোল জোড়া আপনা আপনি সরে গেল দুই পাশে।
দারুণ। হ্যাল হাত বোলাল ওটার তুলতুলে পশমী গায়ে। মুচকি হাসিটা মজাদার এবং কৌতুককর লাগছে। পিঠে একটা চাবিও আছে। খেলনাটা নিয়ে নিচে নেমে এল হাল। খেলবে।
তোমার হাতে ওটা কি, হ্যাল? ঘুম ভেঙে জানতে চাইল বিউলাহ।
কিছু না, বলল হ্যাল। কুড়িয়ে পেয়েছি এটাকে। বেডরুমে, তার পাশের শেলফের মাথায় বানরটাকে রেখে দিল হ্যাল। ওটা হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়ে রইল শূন্যে, ঢোল বেজে ওঠার জন্য তৈরি।
সে রাতে ডিম ডিমা ডিম ডিম শব্দে ঘুম ভেঙে গেল হ্যালের। অজান্তে চোখ চলে গেল বানরটার দিকে। ঢোল বাজাতে শুরু করেছে বানর। শরীর ঝাঁকি খাচ্ছে বাজনার তালে, ঠোঁট জোড়া বারবার বন্ধ হচ্ছে আর খুলছে। বিকট দেখাচ্ছে বড় বড় দাঁতগুলো।
থামো! ফিসফিস করল হ্যাল।
হ্যালের ভাই পাশ ফিরে শুলো। নাক ডাকছে। গভীর ঘুমে অচেতন। সব কিছু নীরব…শুধু বানরটা বাদে। ঢোলে বাড়ি পড়ছে। ডিম ডিমা ডিম ডিম। শব্দ শুনে ওর ভাই জেগে উঠবে, ঘুম ভেঙে যাবে মারও। এতই জোরাল শব্দ, লাশও উঠে পড়বে কবর ছেড়ে।
ডিম ডিমা ডিম ডিম—
হ্যাল হাত বাড়াল বানরের দিকে। এমন সময় থেমে গেল বাজনা। আবার আগের মূর্তি ধরে দাঁড়িয়ে রইল বানর। যেন ভাজা মাছটি উন্টে খেতে জানে না।
বাড়িতে আবার নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে। হ্যাল কম্বলের নিচে ঢুকতে ঢুকতে সিদ্ধান্ত নিল কাল সকালেই বানরটাকে ক্লজিটে রেখে আসবে।
তবে পরদিন সকালে কথাটা ভুলে গেল সে। মা সেদিন কাজে গেল না। কারণ মারা গেছে বিউলাহ্। মা অবশ্য আসল কথা খুলে বলল না দুই ভাইকে। শুধু বলল, ওটা একটা অ্যাক্সিডেন্ট ছিল। ভয়ানক অ্যাক্সিডেন্ট।
সেদিন বিকেলে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে একটা খবরের কাগজ চুরি করে আনল বিল জামার নিচে ঢুকিয়ে। হেড লাইনে ছিল অ্যাপার্টমেন্টে গুলিবিদ্ধ হয়ে দুজন মৃত। মা রান্নাঘরে সাপার তৈরিতে ব্যস্ত, খবরটা বিল পড়ে শোনাল তার ভাইকে। খবরে ছাপা হয়েছে বিউলাহ্ ম্যাককাফেরি (১৯) এবং স্যালি ট্রেমন্ট (২০) কে গুলি করে মেরে ফেলেছে মিস ম্যাককাফেরির ছেলে বন্ধু লিওনার্দ হোয়াইট (২৫)। তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে লিওনার্দ গুলি করে। মিস ট্রেমন্ট হার্টফোর্ড হাসপাতালে মারা যায়, বিউলাহ্ ম্যাককাফেরির মৃত্যু ঘটে ঘটনাস্থলেই।
বিউলাহ খুব গোয়েন্দা গল্প পড়ত। হ্যালের খবরটা শুনে মনে হলো সে তার গোয়েন্দা গল্পের চরিত্রের মতই অদৃশ্য হয়ে গেছে। হঠাৎ মেরুদণ্ড বেয়ে ঠাণ্ডা জলের স্রোত নামতে শুরু করল হ্যালের, স্রোতটা পৌঁছে গেল হৃৎপিণ্ডেও। ওর মনে পড়ে গেছে খুনের ঘটনাটা যখন ঘটে ঠিক ওই সময় বানরটা বাদ্য বাজাচ্ছিল…
হ্যাল? ভেসে এল টেরির দ্রিাতুর কণ্ঠ। ঘুমাবে না?
বাথরুমে দাঁত মাজছিল হ্যাল, পিচিক করে পুতু ফেলে বলল, আসছি।
খানিক আগে বানরটাকে সুটকেসে ভরে ফেলেছে হ্যাল। ওরা দুই/তিনদিনের মধ্যে টেক্সাস যাচ্ছে। তার আগে ওই হারামজাদার একটা স্থায়ী বন্দোবস্ত করা দরকার। যেন আর কোনদিন ওটার মুখ দেখতে না হয়।
যেভাবেই হোক কাজটা করতেই হবে।
তুমি আজ বিকেলে ডেনিশের সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করেছ, অন্ধকারে বলল টেরি।
বিকেলে হ্যালের মুখে মুখে কথা বলার জন্যে ডেনিশকে থাপ্পড় মেরেছে হ্যাল। ছেলেটা দিন দিন বেয়াদব হয়ে যাচ্ছে। অথচ পেটি কত শান্ত। এ জন্যেই ছোট ছেলেটাকে বেশি ভালবাসে হ্যাল।
ডেনিশের সাথে এখন থেকে একটু কড়া না হলে ছেলেটা উচ্ছন্নে যাবে, বলল হ্যাল।
কিন্তু মারলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায় না।
বেশি বেয়াদবি করলে একটু আধটু পিট্টি দিতেই হয়। তাছাড়া ডেনিশ ওর ভুল বুঝতে পেরেছে।
তবু তোমার আচরণ আজ আমার পছন্দ হয়নি, বলল টেরি।
শঙ্কিত বোধ করল হ্যাল। বানরটা কি শুনতে পাচ্ছে তাদের আলাপচারিতা? বিকেলে ডেনিশকে মারার পরে, সন্ধ্যায় বানরটাকে দেখে হ্যালের মনে হচ্ছিল ওটা যেন এই ঘটনায় খুব মজা পেয়েছে। যদিও ডেনিশ ক্ষমা চেয়েছে হ্যালের কাছে। কিন্তু বানরটা যেন মুচকি হেসে বলছিল-তুমি কখনোই ডেনিশের সাথে অন্তরঙ্গ হতে পারবে না। সে যতই চেষ্টা করো। ওটার হাসি দেখে পিত্তি জুলে গিয়েছিল হ্যালের। রাগের চোটে ঢুকিয়ে ফেলেছে সুটকেসে।