এটা একটা বানর, মাথামোটা, বলল ডেনিশ। ওর বয়স বারো। কিন্তু নিজেকে সবজান্তা ভাবে। বানর দেখিসনি কোনদিন?
আমি এটা নিই, বাবা? জানতে চাইল পেটি। ওর বয়স নয়।
মানে! চেঁচাল ডেনিশ। ওটা আমার। বানরটাকে আমি পেয়েছি।
আহ, চুপ কর না তোরা, দাবড়ে উঠল ওদের মা টেরি। চিল্লাচিল্লিতে মাথা ধরে গেল।
ওদের কারও কথা কানে ঢুকছে না হ্যালের। সে ডেনিশের হাতে ধরা বানরটার দিকে তাকিয়ে আছে। বানরটা যেন হ্যালের দিকে তাকিয়ে খিকখিক হাসছে। সেই
পরিচিত হাসি। যে হাসি শৈশবে দুঃস্বপ্নের মত তাড়া করে ফিরেছে হ্যালকে।
বাইরে ঠাণ্ডা বাতাস উঠল। শিসের মত শব্দ তুলল পাক খেতে খেতে। ভয় পেল পেটি। বাবার কাছ ঘেঁষে এল। কিসের শব্দ, বাবা? জিজ্ঞেস করল সে।
বাতাসের শব্দ, সোনা জবাব দিল হ্যাল। স্থির তাকিয়ে আছে বানরটার দিকে। ওটার হাতে ঢোল। হাত উঁচিয়ে আছে বাজানোর ভঙ্গিতে। বাতাস শিস দিতে পারে, কিন্তু সুর তুলতে জানে না, অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বলল ও। হঠাৎ মনে পড়ে গেল ঠিক এ কথাটাই বলতেন উইল চাচা।
লম্বা শিসের শব্দটা আবা: শোনা গেল। ক্রিস্টাল লেকের ওপর দিয়ে বাতাসটা আসছে। অক্টোবরের ঠাণ্ডা বাতাস বাড়ি মারছে হ্যালের মুখে! এ বাড়িটা তাদের হার্টফোর্ডের বাড়ির কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। ত্রিশ বছর আগের সময়টা যেন ফিরে এসেছে এখানে।
আমি ওই ব্যাপারটা নিয়ে আর ভাবব না, সিদ্ধান্ত নিল হ্যাল। কিন্তু ভাবতে না চাইলেই কি আর না ভেবে থাকা যায়? ভাবছে হ্যাল, আমি ব্যাক ক্লজিটে, এরকম একটা বাক্সে হারামজাদা বানরটাকে দেখেছিলাম।
কাঠের একটা ক্রেট বোঝাই নানা হাবিজাবি জিনিস দেখছে টেরি, পেটি বাপের হাত ধরে বলল, এ জায়গাটা আমার ভাল্লাগছে না, বাবা। ভাইয়া ওটা নিতে চায় নিক। চলো, বাবা। এখান থেকে যাই।
ভূতের ভয় লাগছে, মুরগী ছানা? ঠাট্টা করল ডেনিশ।
আহ, ডেনিশ থামলি! চাইনিজ আদলের পাতলা একটা কাপ দেখতে দেখতে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বলল টেরি। জিনিসটা খুব সুন্দর! এটা-হ্যাল দেখল ডেনিশ বানরের পিঠে বসানো চাবিটা নিয়ে তোণ্ডতি করছে। হিম শীতল একটা স্রোত নামল তার শিরদাঁড়া বেয়ে।
ওটা ঘুরাবি না! তীক্ষ্ণ গলায় পেঁচিয়ে উঠল হ্যাল। বুঝতে পারল বেশি জোরে বলে ফেলেছে কথাটা। ডেনিশের সাথে এভাবে ধমকের সুরে কথা বলে না সে অনেকদিন। ডেনিশের হাত থেকে একটানে ছিনিয়ে নিল বানরটাকে। টেরি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল স্বামীর দিকে। ডেনিশ হতভম্ব। পেটিও অবাক। এক মুহূর্তের জন্যে। চুপ হয়ে গেল সবাই। আবার শিস কাটল বাতাস। এবার আগের চেয়ে আস্তে। বানরটাকে এভাবে না নিলেও পারতে, অভিযোগ করল ডেনিশ। জবাবে কিছু বলল না হ্যাল। ক্যালিফোর্নিয়ার ন্যাশনাল এরোডাইন কোম্পানি থেকে চাকরিচ্যুত হবার পর থেকে তার মেজাজটা প্রায়ই খাট্টা হয়ে থাকছে।
ডেনিশ আর কিছু না বলে কার্টনটা আবার ঘটতে শুরু করল। তবে ভাঙাচোরা কিছু পুতুল ছাড়া কিছু পেল না।
বাতাসের বেগ আবার বাড়তে শুরু করেছে। মড়মড় শব্দ হচ্ছে চিলেকোঠায়। যেন সিঁড়ি বেয়ে কেউ নামছে।
হ্যাল বলল, আর এখানে নয়। চলো সবাই।
একটা মোটেলে পাশাপাশি দুটো ঘর ভাড়া নিয়েছে হ্যাল। রাত দশটার মধ্যে ছেলেরা ঘুমিয়ে পড়ল। টেরিও ঘুমাচ্ছে ঘুমের বড়ি খেয়ে। বাথরুমে ঢুকল হ্যাল। বন্ধ করে দিল দরজা। তারপর তাকাল বানরটার দিকে।
নরম, বাদামী লোমে মোড়া বানরটার শরীর। কয়েক জায়গায় পশম উঠে বেরিয়ে পড়েছে নগ্ন গা। হাসি হাসি মুখ। ওর এই হাসিটাকে সবচে ঘৃণা করে হ্যাল। সবগুলো দাঁত বের করে আছে বানরটা। চাবি মোড়ালে ঠোঁট নড়বে, দাতগুলো মনে হবে আরও বড় হয়ে গেছে, অবিকল ভ্যাম্পায়ারের দাঁত। ঢোল বাজাতে শুরু করবে বানর। এই হারামজাদাটা হ্যালের সবচে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। জনি ম্যাকবির মৃত্যুর জন্য দায়ী। সবাই জানে জনি গাছ থেকে পড়ে ঘড়ি ভেঙেছে। কিন্তু হ্যাল জানে এই খেলনা বানরটাই খুন করেছে তার বন্ধুকে। হ্যাল দেখেছে এটা যখন ঢং ঢং শব্দে ঢোল বাজাতে শুরু করে তখনই কারও না কারও করুণ মৃত্যু ঘটে। অথচ এটাকে ত্রিশ বছর আগে কুয়োয় ফেলে দিয়েছিল সে।
তুমি এখানে কিছুতেই আসতে পারো না, ফিসফিস করে বলল হ্যাল। কারণ নয় বছর বয়সে তোমাকে আমি আমাদের বাড়ির কুয়োয় ফেলে দিয়েছিলাম।
বানরটা হ্যালের কথা শুনে মুখের হাসিটা যেন প্রসারিত করল। শিউরে উঠল হ্যাল। হাত থেকে ফেলে দিল ওটাকে। বাইরে, রাতের আঁধারে ঠাণ্ডা হাওয়ার দাপাদাপি। মোটেলটাকে বারবার ঝাঁকি মেরে যাচ্ছে।
হ্যালরা দুই ভাই। হ্যাল ও বিল। খুব ছোটবেলায় ওদের ব্যবসায়ী বাবা ওদেরকে ছেড়ে চলে যায়। বাবার কথা বিলের অল্প অল্প মনে আছে। কি হলের স্মৃতিতে বাবার চেহারাটা নেই। হ্যাশের আট বছর বয়সে মা মারা যান। বিল তখন দশে পড়েছে। তারপর ওরা হার্টফোর্ডে চলে আসে চাচা-চাচীর কাছে। চাচা উইল এবং চাচী ইডা খুব আদর করতেন দুই ভাইকে। ওখানেই বড় হয়ে ওঠে ওরা! কলেজে যায়। বিল বর্তমানে পোর্টল্যান্ডে আইন ব্যবসা করছে। ভালই পসার তার।
বানরটাকে হ্যাল প্রথম দেখেছে চার বছর বয়সে। ওদের বাবা হাটফোর্ডে বাড়ি কিনেছিলেন, মা হোমস এয়ার ক্রাফটে তখন সেক্রেটারির কাজ করেন। ছয় বছরের বিল স্কুলে যায়। হার্টফোর্ডে অনেক বেবী সিটার ছিল, নানা জায়গা থেকে আসত। বাচ্চা দেখাশোনাই ছিল তাদের প্রধান কাজ। এরকম এক কৃষ্ণাঙ্গী, বিশালদেহী বেবী সিটারের নাম ছিল বিউলাহ। হ্যালের মা কাজে গেলে সে হ্যালের দেখাশোনা করত। বিউলৗহ যখন তখন চিমটি কাটত হ্যালকে। তারপরও হ্যাল পছন্দ করত বিউলাহকে সে মজার মজার গল্প শোনাত বলে।