আমি ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করার জন্যে বিছানা থেকে নামতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু তার আগেই ঘুরে দাঁড়াল ভ্যাম্পায়ার, বিদ্যুৎগতিতে পৌঁছে গেল আমার বিছানার পাশে। আর ঠিক তখুনি একটা ভেল্কি দেখলাম আমরা। রূপার গায়ে থাবা চালিয়েছে ভ্যাম্পায়ার, একই সঙ্গে বিদ্যুত্তমকের মত লাফিয়ে উঠেছে মোতি, ঝাঁপিয়ে পড়ল পিশাচটার গায়ে। কিন্তু চোখের পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল ভ্যাম্পায়ার মোতিকে বোকা বানিয়ে।
বীনা লাফিয়ে নামল খাট থেকে। এক দৌড়ে রূপার বিছানায়। ভয়ানক দৃশ্যটা দেখে মাথা ঘুরে গেল আমার। ভ্যাম্পায়ারটার থাবার আঘাত লেগেছে রূপার ঘাড়ে, স্রোতের বেগে রক্ত পড়ছে। ভয়ে, যন্ত্রণায় অজ্ঞান হয়ে গেছে আমার মেয়ে। রূপার ঘাড়ে কোন মতে ব্যান্ডেজ বেঁধে তক্ষুণি ওকে নিয়ে ছুটলাম হাসপাতালে। আর আধাঘণ্টা দেরী হয়ে গেলে মেয়েকে বাঁচানো যেত না, এতই রক্তক্ষরণ হচ্ছিল।
যমে-মানুষে লড়াই চলল টানা দুই দিন। এই দুই দিন অজ্ঞান হয়ে রইল রূপা। তিন দিনের দিন জ্ঞান ফিরল ওর। এখন আগের চেয়ে সুস্থ। তবে বেচারীর শরীরে একটুও শক্তি নেই। অবশ্য কয়েকদিনের মধ্যে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবে রূপা।
এ ঘটনার পরে আপনার এজেন্সিতে চিঠি লিখি আমি। প্রথমে পুলিশের কাছে যাব ভেবেছিলাম। কিন্তু ভ্যাম্পায়ারের কথা হয়তো বিশ্বাসই করবে না তারা। উল্টো হাসাহাসি করবে আমাকে নিয়ে। পাগল ঠাওড়াবে। আর ডাক্তারদেরকে বলেছি খেলতে গিয়ে সিঁড়ি থেকে পড়ে ব্যথা পেয়েছে রূপা।
ওই ঘটনার পর থেকে আমাদের জীবনে শান্তি বলে কিছু নেই। সেদিনের পরে ভ্যাম্পায়ারের চেহারা আর দেখিনি বটে। তবে আমার বিশ্বাস আবার ফিরে আসবে সে। আমার মা ওঝা ডেকে এনেছিলেন। কে জানে হয়তো তার মন্ত্রের জোরে সাময়িকভাবে পালিয়েছে ভ্যাম্পায়ার। ওঝা সদর দরজায় কঙ্কাল টাঙিয়ে রেখেছে। বলেছে মন্ত্রপূত এ কঙ্কাল ঠেকিয়ে রাখবে ভ্যাম্পায়ারকে। ওঝার কথা বিশ্বাস হয়, আবার হয়ও না। জানি না শেষ পর্যন্ত ভাগ্যে কি আছে।
গল্প শেষ হলো মি. গুহর। রাতের খাবারের আগে আরও কিছুক্ষণ ড্রইংরুমে কাটিয়ে দিলাম দুজনে নানা বিষয়ে আলোচনা করে। ডিনার সারতে হলো পরিবারের সকল সদস্যদের নিয়ে। ভ্রমণে ক্লান্ত ছিলাম বলে তাড়াতাড়ি বিছানায় গেলাম। কিন্তু ঘুম এল না সহজে। বারবার ভ্যাম্পায়ারের কথা মনে পড়ছে।
ভ্যাম্পায়ার? রক্তচোষা ভ্যাম্পায়ার, সত্যি সম্ভব এ যুগে? কিন্তু কি করে সম্ভব? অথচ মি. গুহর চেহারা দেখে এবং কথা শুনে মনে হয়েছে ভ্যাম্পায়ারের অস্তিত্ব প্রবলভাবে বিশ্বাস করেন তিনি। আর এমন গণ্যমান্য একজন ব্যক্তির কথা হালকাভাবে নেয়ার কোন অবকাশ নেই। আমি আমার হেভী-ক্যালিবারের রিভলভারটা বালিশের তলায় গুজে ঘুমাবার চেষ্টা করলাম। কখন ঘুমিয়ে পড়েছি এবং কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানি না। হঠাৎ জেগে উঠলাম। চোখ মেলে চাইতেই হিম হয়ে গেল গা। ডিম বাতির নীলচে আলোয় দেখলাম এক লোক দাঁড়িয়ে আছে আমার বিছানার পাশে। অতি সাধারণ বেশভূষা তার, চেহারায়ও কোন বিশেষত্ব নেই। শুধু চোখজোড়া ছাড়া। ভয়ানক জ্বলছে তার চোখ লাল টকটকে। আমি কিছু বলার আগেই সে মুখ খুলল।
আমিই সেই ভ্যাম্পায়ার, ফাসফেঁসে, কঁপা কণ্ঠ তার। তুমি বোকা, তাই এখানে এসেছ। এখান থেকে চলে যাও। নইলে তুমিও মারা পড়বে। কাল যেন তোমাকে আর এ বাড়িতে না দেখি। বলে ঘুরে দাড়াল সে।
ভয়ে আমার শরীর প্রায় অসার হয়ে গিয়েছিল। বহু কষ্টে বালিশের নিচে হাত ঢুকিয়ে বের করে আনলাম রিভলভার। ভ্যাম্পায়ার ঘুরে দাঁড়াতেই তাকে লক্ষ্য করে গুলি করলাম। বন্ধ ঘরে বিকট শোনাল গুলির আওয়াজ। মনে হলো গুলি লেগেছে। ভ্যাম্পায়ারের গায়ে। কারণ ঝাঁকি খেতে দেখেছি ওকে গুলি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। উল্লসিত হয়ে উঠলাম আমি। ওটা ভ্যাম্পায়ার নয়, মানুষ, ভাবলাম আমি। তাই গায়ে গুলি লেগেছে।
ধীরে ধীরে শরীরটা ঘুরে দাড়াল আমার দিকে। পরপর আরও দুবার গুলি করলাম। দুবারই ঝাঁকি খেল ভ্যাম্পায়ার। বারুদের গন্ধে ভরে গেল ঘর। গুলির শব্দে কানে তালা লাগার জোগাড়।
আমি তোমাকে শেষ করব, আশ্চর্য ঠাণ্ডা গলায় বলল ভ্যাম্পায়ার। তারপর পা বাড়াল ঘরের অন্ধকার কোণের দিকে। অদৃশ্য হয়ে গেল। বিছানা থেকে নেমে পড়লাম আমি। স্ত হাতে আলো জ্বালালাম। ডান হাতে রিভলভার বাগিয়ে ধরে একে একে পরীক্ষা করে দেখলাম বাথরুম, কাপবোর্ড এমনকি বিছানার তলাও। কোথাও ভ্যাম্পায়ারের চিহ্ন নেই। দরজা-জানালা বন্ধ করেই শুয়েছিলাম। তাহলে কোখেকে ঢুকল ওটা? এরকম জিনিসের সঙ্গে মোকাবিলা আমার এই প্রথম। ভ্যাম্পায়ারের কথা ভাবছি, এমন সময় দরজায় দমাদম বাড়ি। গুহর কণ্ঠ শুনতে পেলাম। দরজা খুলতে বলছেন।
রিভলভার হাতে নিয়েই সাবধানে খুলে দিলাম দরজা। গুহই। ড্রেসিং গাউন পরনে, চুল এলোমেলো, এক চাকরকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। আমার হাতে অস্ত্র দেখে আঁতকে উঠলেন, এক লাফে পিছু হটলেন। অবশ্য পরের মুহূর্তে ঘরে ঢুকলেন।
কি হয়েছে? জানতে চাইলেন মি. গুহ। গুলির আওয়াজ শুনলাম যেন!
ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করলাম তার কাছে। মাই গড! শিউরে উঠলেন মি. গুহ। অল্পের জন্যে প্রাণে বেঁচে গেছেন। সত্যি কি ভ্যাম্পায়ারটার গায়ে গুলি লেগেছে?