স্বাভাবিকভাবেই ছড়িয়ে পড়ল আতঙ্ক। আমাদের বাড়িটাকে সভয়ে এড়িয়ে চলতে শুরু করল মানুষজন। পালিয়ে গেল চাকর-বাকররা। পরিবারের সদস্যরাও এ বাড়ি বর্জন করলে এটি ভূতুড়ে বাড়িতে পরিণত হলো। একজন কেয়ারটেকার রেখে দেয়া হলো বাড়ি দেখাশোনার জন্যে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় প্রাণভয়ে আমর ভারত চলে যাই। ওখান থেকে অন্য দেশ। অনেকদিন বিদেশে ছিলাম। বিদেশ থেকে ফেরার পরে দেখি, এ বাড়ি ছাড়া আমাদের বেশিরভাগ সম্পত্তি বেদখল হয়ে গেছে। বাবা এতে শর্ড হয়ে হার্ট অ্যাটাক করে বসেন আগেই বলেছি। তবে বাড়ির পূর্বইতিহাস জানতেন বলে তিনি চাননি এখানে কেউ বাস করুক।
সত্যি বলতে কি বাবার কথা পুরোপুরি বিশ্বাস হয়নি আমার। এ যুগে ভ্যাম্পায়ারের অস্তিত্ব বিশ্বাস করাটাই তো পাগলামি। কিন্তু ভুল ভেবেছিলাম। আর সে ভুলের খেসারত আমাকে দিতে হয়েছে ভয়ঙ্করভাবে।
থামলেন মি. গুহ। কৌতূহল নিয়ে তাকালাম তার দিকে। উনি কি বলতে চাইছেন ভ্যাম্পায়ারের সত্যি অস্তিত্ব রয়েছে? গ্লাসে ড্রিংকস ঢেলে কিছুক্ষণ চুপচাপ পান করে চললাম। ইতিমধ্যে দ্বিতীয় ঝাড়বাতি জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে এক চাকর। আমাদের পরিবারের গোপন ইতিহাস বলার কয়েক ঘণ্টা পরে মারা গেলেন বাবা। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পরে বিষয়টি নিয়ে কথা বললাম আমার মা এবং স্ত্রীর সাথে। মা বললে এ ধরনের গুজব তিনিও শুনেছেন। তবে বাবা কখনও এ বিষয় নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেননি। মার ধারণা এটা স্রেফ গুজবই, এ নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। মার কথায় সায় দিলাম। তবে আমার স্ত্রীর চেহারা দেখে মনে হলো গুজবটা সে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে।
ঢাকায় আমাদের পারিবারিক স্ট্যাটাস অনুযায়ী থাকতে গেলে প্রচুর অর্থের দরকার ছিল। আর অত টাকাও আমার ছিল না। তাই বাবার প্রবল নিষেধাজ্ঞা মাথা থেকে দূর করে দিয়ে আমরা পিতৃ-পুরুষের বাড়িতেই বসবাস শুরু করে দিই।
শুরুতে অবশ্য কোন সমস্যা ছিল না। ভালই কাটছিল দিনকাল। একটা সময় আমরা বিশ্বাস করতে শুরু করি ভ্যাম্পায়ারের গল্প আসলে গল্পই। এ জায়গায় নাটকীয় ভঙ্গিতে বিরতি দিলেন গুহ। গ্লাসে বড় একটা চুমুক দিয়ে বললেন, ঠিক তখন হামলা চালাল ভ্যাম্পায়ার। এক রাতে, বলে চললেন তিনি, দেরী করে ফিরেছি পার্টি থেকে। অধিক ভোজনের ক্লান্তিতে বিছানায় শোয়ামাত্র ঘুম। হঠাৎ কেমন একটা অস্বস্তি নিয়ে ভেঙে গেল ঘুম। চেয়ে দেখি এক লোক দাড়িয়ে আছে আমার বিছানার পাশে। সাধার চেহারার মানুষটির বেশভূষাও সাধারণ, শুধু চোখ জোড়া ছাড়া। টকটকে লাল চোখ থেকে আগুন যেন ঠিকরে বেরুচ্ছিল। এমন ভয়ানক চাউনি, শরীর অবশ হয়ে গেল আমার মুখ হা করলাম, শব্দ বেরুল না গলা থেকে।
নিচু, কাঁপা গলায় কথা বলে উঠল আগন্তুক, চলে যাও ? তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি, এখান থেকে চলে যাও। তোমার সঙ্গে আমার কোন শত্রুতা নেই। কিন্তু আমার সাবধান বাণীর পরেও যদি এ বাড়িতে থাকো, আক্রান্ত হবে তোমরা। কারণ এ পরিবারের রক্ত খাওয়ার শপথ নিয়েছিলাম আমি। কাজেই আমার হাত থেকে বাঁচতে চাইলে এক্ষুণি কেটে পড়ো।
কথা শেষ করেই অদৃশ্য হয়ে গেল লোকটা। আমি হতবুদ্ধির মত শুয়ে রইলাম বিছানায়। সারা গা কাঁপছে। ঘুম থেকে জাগালাম আমার স্ত্রী বীনাকে। ঘটনাটা খুলে বললাম ওকে। বীনা অভয় দিয়ে বলল ও কিছু না। পার্টিতে বেশি খেয়ে ফেলেছি বলে উল্টোপাল্টা স্বপ্ন দেখছি। গুরুপাক ভোজনে অমন হতেই পারে। তবে বীনার যুক্তি মেনে নিতে পারলাম না। স্বপ্ন নয়, সত্যি কেউ একজন এসেছিল আমাদের ঘরে। শাসিয়ে গেছে আমাকে।
দরজা-জানালা পরীক্ষা করে দেখলাম! সব বন্ধ। আমার ছোট্ট মেয়েটা নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। বীনা তাগাদা দিল ঘুমিয়ে পড়তে। শুয়ে পড়লাম। তবে সে রাতে আর ঘুম এল না। আগন্তুকের কথা মনে পড়ল বারবার।
পরদিন সকালেই চলে এলাম শহরে। বাড়ি খুঁজতে। আর্গের বাড়িতে থাকতে ভয় করছিল। তবে মা কিংবা বীনাকে জানাইনি ভয়ের কথা। ওদেরকে জত করে তুলতে চাইনি। তবে সারা দিন বাড়ি খোজাই সার হলো। পেলাম না মনের মত বাড়ি। সন্ধ্যাবেলায় বাসায় ফিরলাম ক্লান্ত এবং হতাশ হয়ে। দুশ্চিন্তাও হচ্ছিল বেশ। তবে চেহারা ভাবলেশশূন্য রেখে রাতের খাবার খেলাম সবার সাথে। সে রাতে একটু তাড়াতাড়িই গেলাম বিছানায়।
আমাদের কুকুর মোতি সাধারণত বারান্দায় ঘুমায়। সে রাতে সৌভাগ্যক্রমে ও খেলা করছিল আমার মেয়ে রূপার সঙ্গে। আমার খাটের নিচেই খেলা শেষে শুয়ে পড়েছিল জানোয়ারটা।
রাত আনুমানিক দুটোর দিকে মোতির ঘেউ ঘেউ ডাকে ঘুম ভেঙে গেল আমার। বীনাও জেগে গেছে। সাথে সাথে চিৎকার শুরু করে দিল ও।
ভ্যাম্পায়ারটা আবার ঢুকে পড়েছে ঘরে। টকটকে লাল চোখে, প্রতিহিংসার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। ধীরে ধীরে, ফ্যাঁসফেঁসে গলায় কথা বলতে শুরু করল সে।
তোমাকে বলেছিলাম এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে। আমার আদেশ অমান্য করেছ। এ জন্যে এখন শাস্তি পেতে হবে তোমাকে। তোমার মেয়ের রক্ত খাব আমি। ও মারা যাবে।
মোতি ভ্যাম্পায়ারের সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে সমানে ঘেউ ঘেউ করে চলছিল। ভ্যাম্পায়ার ওকে গ্রাহ্যই করছিল না। মোতির চিৎকার ছাপিয়েও তার কণ্ঠ পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছিলাম আমরা।