দিনের আলোতে আবার সে পথে পথে ঘুরে বেড়াবে জীবিত মানুষের খোঁজে। পৃথিবীর সব জীবিত মানুষকে একত্র না করলে আবার কেমন করে শুরু হবে নূতন পৃথিবী? হয়তো তারই মতো নিঃসঙ্গ কোনো তরুণ পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে, খুজছে তারই মতো কোনো। তরুণীকে। তারা দুজন দুজনকে সান্ত্বনা দেবে, সাহস দেবে, শক্তি দেবে, ভালবাসা দেবে, নূতন পৃথিবীর জন্ম দেবে।
রাত কাটানোর জন্যে নিয়ানা যে বাসাটি বেছে নিল তার বাইরে ফুলের বাগান আগাছায় ঢেকে গেছে। দীর্ঘদিনের অব্যবহারে বাসার সিঁড়ি ধুলায় ধূসরিত। দরজা ধাক্কা দিতেই কাঁচক্যাচ শব্দ করে খুলে গেল। দেয়ালে হাত দিয়ে সুইচ অন করতেই আলো জ্বলে উঠল। কী আশ্চর্য! বাসাটিতে ইলেকট্রিসিটির জন্যে যে ব্যাটারি রেখেছিল এখনো সেটি কাজ করছে।
ঘরের কার্পেটে পা ছড়িয়ে বসল নিয়ানা, পিঠ থেকে ব্যাগ নামিয়ে শুকনো কিছু খাবার বের করল, তার সাথে পানির বোতল। শুকনো খাবার চিবিয়ে চিবিয়ে খেল সে দীর্ঘ সময় নিয়ে, তারপর বোতল থেকে খানিকটা পানি খেয়ে স্লিপিং ব্যাগের ভিতরে ঢুকে গেল। দীর্ঘ সময় সে নিদ্রাহীন চোখে শুয়ে রইল। সারাদিন হেঁটে হেঁটে সে ক্লান্ত, কিন্তু তবু তার চোখে ঘুম আসে না। বিশাল পৃথিবীতে একা নিঃসঙ্গ বেঁচে থাকার মতো কঠিন বুঝি আর কিছু নয়! নিয়ানার মনে হয়, কখনোই তার চোখে ঘুম আসবে না, কিন্তু এক সময় নিজের অজান্তেই ঘুম নেমে এল।
নিয়ানার ঘুম ভাঙল একটি শব্দে, মনে হল সে কারো গলার স্বর শুনতে পেয়েছে, চমকে উঠে বসল সে। কান পেতে শোনার চেষ্টা করল আবার, আবার সে মানুষের কণ্ঠস্বর শুনতে পেল। এবারে এক জনের নয়, একাধিক জনের। কী আশ্চর্য! নিয়ানা লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল, জীবিত মানুষ এসেছে এখানে। সে প্রায় ছুটে গিয়ে জানালার কাছে দাঁড়াল, পরদা সরিয়ে বাইরে দেখার চেষ্টা করল তীক্ষ্ণ চোখে। চাঁদের অস্পষ্ট আলোতে অবাক হয়ে দেখল সত্যি সত্যি তিন জন ছায়ামূর্তি নিচু গলায় কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসছে এই বাসার দিকে। উত্তেজনায় নিশ্বাস নিতে ভুলে যায় সে, দুই হাত নেড়ে চিৎকার করে ওঠে আনন্দে। ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দিল নিয়ানা, অধীর আগ্রহে দাঁড়িয়ে রইল মানুষ তিন জনের জন্যে। এখনো সে বিশ্বাস করতে পারছে না, মানুষ এসেছে তার কাছে, সত্যিকারের জীবন্ত মানুষ!
মানুষ তিন জন ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে পিঠ থেকে ঝোলা নিচে নামিয়ে রাখল। নিয়ানা কী বলবে ঠিক বুঝতে পারছিল না, কোনোমতে নিজেকে সংবরণ করে বলল, তোমাদের দেখে কী যে ভালো লাগছে আমার! কতদিন থেকে আমি মানুষকে খুঁজে বেড়াচ্ছি বিশ্বাস করবে না।
মানুষ তিন জন কোনো কথা না বলে নিয়ানার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তিন জনের ভিতরে দুজন মধ্যবয়স্ক, তৃতীয় জন প্রায় তরুণ। গায়ের জামাকাপড় ধূলিধূসরিত। ক্লান্তিজনিত কারণের জন্যেই কি না কে জানে, চেহারায় এক ধরনের কঠোরতার ছাপ রয়েছে। নিয়ানা তাদের ঝোলার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ চমকে উঠল– সেখান থেকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র উঁকি দিচ্ছে। নিয়ানা আবার বলল, তোমরা নিশ্চয়ই খুব ক্লান্ত? আমার কাছে কিছু শুকনো খাবার আছে। এই বাসায় খুঁজলে–
নিয়ানাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ জিজ্ঞেস করল, তোমার বয়স কত?
নিয়ানা থতমত খেয়ে বলল, বয়স? আমার?
হ্যাঁ।
উনিশ। এই বসন্তে উনিশ হয়েছি।
মানুষটি জিব দিয়ে এক ধরনের শব্দ করে তার সঙ্গীদের দিকে তাকিয়ে বলল, বিশ্বাস করতে পার? উনিশ বছরের একটা যুবতী পেয়ে গেলাম।
নিয়ানা মানুষটির কণ্ঠস্বর শুনে চমকে উঠে বলল, কী? কী বলছ তুমি?
মানুষটি কোনো কথা না বলে জিব দিয়ে ঠোঁট চেটে হঠাৎ একটা বিচিত্র ভঙ্গিতে হাসতে থাকে। নিয়ানা হঠাৎ এক ধরনের ভয়ংকর আতংক অনুভব করে।
এক থেকে তিনের মাঝে একটা সংখ্যা বল দেখি সুন্দরী।
নিয়ানা ঢোক গিলে বলল, কেন?
আমাদের তিন জনের মাঝে কে তোমাকে নিয়ে প্রথমবার স্ফুর্তি করব সেটা ঠিক করব।
মানুষটির কথা শুনে অন্য দুজন মানুষ হঠাৎ শব্দ করে হেসে উঠল। নিয়ানা রক্তশূন্য ফ্যাকাসে মুখে পিছিয়ে গিয়ে দেয়াল স্পর্শ করে দাঁড়াল, হঠাৎ তার মনে হতে থাকে সে বুঝি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না। জোরে জোরে কয়েকটা নিশ্বাস নিয়ে বলল, কী বলছ তোমরা? সারা পৃথিবীতে এখন মাত্র আমরা কয়েকজন মানুষ। এখন আমরা সবাই যদি একে অন্যকে সাহায্য না করি, মিলেমিশে না থাকি
মিলে–মিশে মিলে–মিশে তরুণটি হঠাৎ একটা কুৎসিত ভঙ্গি করে বলল, তাই তো করব! মিলে–মিশে যাব।
না! নিয়ানা করুণ চোখে বলল, তোমরা এরকম করতে পারবে না। দোহাই তোমাদের ঈশ্বরের দোহাই–
মধ্যবয়স্ক নিষ্ঠুর চেহারার মানুষটি এক পা এগিয়ে এল। তার চোখে এক ধরনের হিংস্র লোলুপ ভাব স্পষ্ট হয়ে এসেছে, জিব দিয়ে ঠোঁট চেটে বলল, পৃথিবীতে এখন কোনো মানুষ নেই মেয়ে। আইন তৈরি হয় মানুষের জন্যে, যেহেতু মানুষ নাই তাই আইনও নাই। আমরা যেটা বলব সেটা হবে আইন। যেটা করব সেটা হবে নিয়ম।
মানুষটি আরো এক পা এগিয়ে গিয়ে নিয়ানাকে স্পর্শ করে বলল, আস সুন্দরী। লজ্জা কোরো না
ভয়াবহ আতংকে নিয়ানা থরথর করে কাঁপতে থাকে।
***
মানুষটি মাথা নিচু করে উবু হয়ে বসে আছে, তার হাত দুটি পিছনে শক্ত করে বাঁধা। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কয়েকজন নানা বয়সী মেয়ে, সবার হাতেই কোনো না কোনো ধরনের অস্ত্র। মানুষটি মাথা তুলে কাতর গলায় বলল, আমাকে কেন তোমরা ধরে এনেছ?