না, আমি চাই না।
চাও না?
না। আমার কথা তুমি কাউকে বলতে পারবে না।
ফ্রেডি কাঁপা গলায় বলল, বলতে পারব না?
না।
ফ্রেডি কাঁপা গলায় বলল, যদি বলি?
তাহলে আমি বলব সব জাল–জুয়াচুরি! কেউ তোমার কথা বিশ্বাস করবে না।
বিশ্বাস করবে না? ফ্রেডি হঠাৎ তার বুক চেপে সাবধানে চেয়ারে বসে পড়লেন, তার মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠে, বাম পাশে কেমন যেন ভোঁতা এক ধরনের ব্যথা দানা বেঁধে উঠছে। ফ্যাকাসে মুখে বড় একটা নিশ্বাস নিয়ে বললেন, ঠিকই বলেছ এলবার্ট। তোমার কথা কেউ অবিশ্বাস করবে না। আইনস্টাইনকে কে অবিশ্বাস করবে?
***
মন্টানার একটি কমিউনিটি কলেজে এলবার্ট নামের যে সঙ্গীতশিক্ষক ছিলেন তাকে যে–ই দেখত সে–ই বলত, আপনাকে কোথায় জানি দেখেছি বলতে পারেন?
এলবার্ট নামের সেই সঙ্গীতশিক্ষক হেসে বলতেন, কারো কারো চেহারাই এরকম দেখলেই মনে হয় চেনা চেনা!
যদি সঙ্গীতশিক্ষক তার চুল এবং গোঁফকে অবিন্যস্তভাবে বড় হতে দিতেন তাহলে কেন তাকে চেনা মনে হত ব্যাপারটি কারো বুঝতে বাকি থাকত না। কিন্তু তিনি কখনোই সেটা করেন নি।
একটি কুৎসিত প্রাণী
প্রাণীটাকে তুলে নাও।
আমি পারব না। তুমি তুলে নাও।
কেন তুমি পারবে না?
আমার ঘেন্না করছে। এরকম কুৎসিত প্রাণী আমি আগে কখনো দেখি নি।
কেন তুমি ধরে নিলে মহাজগতের সব প্রাণী সুদর্শন হবে?
তাই বলে এরকম বীভৎস? এরকম কুৎসিত?
কিছু করার নেই।
দেখেছ শরীর থেকে কী রকম ডালপালার মতো বের হয়ে এসেছে। দুটি উপরে দুটি নিচে তার মাথায় আবার কিলবিলে কিছু জিনিস। কেমন করে নড়ছে দেখেছ?
দেখেছি।
দেখলে ঘেন্না করে না?
করে। কিন্তু তুমি জান আমাদের একটা প্রাণীকে ধরে নিয়ে যেতে হবে।
আমি পারব না। এরকম কুৎসিত প্রাণীকে আমি স্পর্শও করতে পারব না।
কেন তুমি সময় নষ্ট করছ?
প্রাণীটার সবচেয়ে কুৎসিত কী জিনিস জান?
কী?
তার নড়াচড়া করার ভঙ্গি। দেখেছ কেমন কিলবিল করে নড়ে।
হ্যাঁ। উপরের অংশটা আবার খানিকটা ঘুরতে পারে। সেখানে জায়গায় জায়গায় আবার ঠেলে বের হয়ে আসছে, তার মাঝে আবার গর্ত।
কী কুৎসিত গর্ত, সেগুলি আবার ভেজা ভেজা। স্যাঁতসেঁতে। ছি!
ঠিকই বলেছ, উপরে নিচে পাশেও গর্ত রয়েছে। মাঝখানের গর্ত থেকে লালচে কী একটা বের হল আবার ঢুকে গেল।
উপরের দিকে রোয়া রোয়া কী বের হয়ে এসেছে দেখেছ? পেঁচিয়ে আছে কোথাও কোথাও, কী বীভৎস দেখায় দেখেছ?
দেখেছি। কিন্তু এখন আর কথা না বলে একটাকে তুলে নাও। আমাদের বেশি সময় নেই।
আমি পারব না। তুমি বলে দাও এটা বুদ্ধিমান প্রাণী। বুদ্ধিমান প্রাণী হিসেবে দেখাতে পারলে আমাদের এটা নিতে হবে না।
কিন্তু তুমি জান এটা বুদ্ধিমান প্রাণী নয়। বুদ্ধিমান প্রাণী কখনো নিজেরা নিজেদেরকে ধ্বংস করে না।
তা ঠিক।
তুমি একটা প্রাণীকে তুলে নাও।
ঠিক আছে, তুলছি। কিন্তু জেনে রাখ এটাই শেষ। আর কখনো এরকম কুৎসিত একটা প্রাণী আমি স্পর্শ করব না। ঠিক আছে?
ঠিক আছে।
***
পৃথিবীকে পর্যবেক্ষণরত মহাজাগতিক কিছু প্রাণী খুব সাবধানে একটি মানুষকে তাদের মহাকাশযানে তুলে নিল।
ওয়াই ক্রমোজম
গোল চত্বরটি নিশ্চয়ই এক সময় এই শহরের কেন্দ্রবিন্দু ছিল, বিকেলবেলা মানুষেরা এখানে হয়তো ভিড় করে আসত সময় কাটাতে। শিশুরা আসত তাদের মায়ের পিছু পিছু তরুণ তরুণীরা আসত হাত ধরাধরি করে। কাফেতে উচ্চ তালের সঙ্গীতের সাথে হইহুল্লোড় করত শ্রমজীবী মানুষেরা। এখন কোথাও কেউ নেই। নিয়ানা রেলিঙে হেলান দিয়ে সামনে তাকাল, যতদূর চোখ যায় ধু–ধু জনমানবহীন। সারা পৃথিবী জুড়ে এরকম লক্ষ লক্ষ শহর এখন জনহীন মৃত। মাত্র এক বছরের মাঝে ল্যাবরেটরির গোপন ভল্ট থেকে ছাড়া পাওয়া ভাইরাস মিটুমাইন পৃথিবীর প্রায় সব মানুষকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। সাধারণ ফ্লুয়ের মতো উপসর্গ হত প্রথমে, তৃতীয় দিনে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়ে মানুষ পোকামাকড়ের মতো মারা যেতে শুরু করল। পৃথিবীতে বিংশ শতাব্দীর সভ্যতার সব চিহ্ন মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রইল–আকাশচুম্বী দালান, দীর্ঘ হাইওয়ে, কলকারখানা, লাইব্রেরি, দোকানপাট, হাসপাতাল, স্কুল–কলেজ, মিউজিয়াম–শুধু কোথাও কোনো মানুষ রইল না। নিয়ানার মতো অল্প কিছু মানুষ শুধু বেঁচে রইল, প্রকৃতির বিচিত্র কোনো খেয়ালে তাদের জিনেটিক কোডিং মিটুমাইন ভাইরাসের আক্রমণে কাবু হল না; সারা পৃথিবীতে এখন বেঁচে থাকা মানুষের সংখ্যা হাত দিয়ে গোনা যায়। সূর্যের পড়ন্ত আলোতে–মৃত একটি শহরে জনমানবহীন ধু–ধু প্রান্তরের দিকে তাকিয়ে নিয়ানার পুরো ব্যাপারটিকে একটি ভয়ংকর দুঃস্বপ্নের মতো মনে হয়। তার বেঁচে থাকার ব্যাপারটি কি সৌভাগ্য নাকি দুর্ভাগ এখনো সে বুঝে উঠতে পারে না।
খুব ধীরে ধীরে অন্ধকার নেমে আসছে। নিয়ানা এখানে একা একা আরো খানিকক্ষণ অপেক্ষা করবে, তারপর হেঁটে হেঁটে যাবে শহরের ভেতর। কোনো একটি বাসার দরজা খুলে সে ভিতরে ঢুকবে; সেখানে সাজানো ঘর থাকবে, বিছানা থাকবে, রান্নাঘরে চুলোর উপর কেতলি বসানো থাকবে, ছোটশিশুর খেলাঘর থাকবে, লাইব্রেরিঘরে বই থাকবে, দেয়ালে পরিবারটির হাস্যোজ্জ্বল ছবি থাকবে, শুধু কোথাও কোনো মানুষ থাকবে না। মিটুমাইন ভাইরাসের প্রবল আতংকে সব মানুষ ঘর ছেড়ে চলে গিয়েছিল, পাহাড়ে বনে ক্ষেতে খামারে–কেউ রক্ষা পায় নি শেষ পর্যন্ত। সেই জনমানবহীন ভুতুড়ে ঘরের এক কোনায় নিয়ানা স্লিপিং ব্যাগের ভিতরে গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকবে। অন্ধকার ঘরে শুয়ে শুয়ে সে অপেক্ষা করবে রাত কেটে ভোর হওয়ার জন্যে।