ফ্রেডি শিশুটিকে চমৎকার একটা পরিবেশে বড় হওয়ার জন্যে যা যা প্রয়োজন তার সব ব্যবস্থা করে দিলেন। শহরতলিতে একটা ছবির মতো বাসা, পিছনে একটা ঝিল, ঝিলের পাশে পাইন গাছ। ঘরের ভিতরে ফায়ারপ্লেস, বড় লাইব্রেরি, বসার ঘরে গ্র্যান্ড পিয়ানো, চমৎকার উজ্জ্বল রঙে সাজানো শোয়ার ঘর, পায়ের কাছে খেলনার বাক্স, মাথার কাছে সুদৃশ্য কম্পিউটার।
শিশুটি চমৎকার পরিবেশে বড় হতে থাকে। তার মানসিক বিকাশলাভের প্রক্রিয়াটি খুব তীক্ষ্ণ নজরে রাখা হল। প্রকৃত আইনস্টাইনের মতোই তার পড়াশোনায় খুব মন নেই। এলজেবরা বা জ্যামিতি দুই–ই চোখে দেখতে পারে না। কম্পিউটারের নূতনত্বটুকু কেটে যাবার পর সেটিতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলল। সঙ্গীতে অবশ্যি এক ধরনের আকর্ষণ গড়ে উঠল, একা একা দীর্ঘ সময় গ্র্যান্ড পিয়ানো টেপাটেপি করে, মনে হয় এইটুকু বাচ্চার ভিতরে প্রচণ্ড এক ধরনের সুরবোধ রয়েছে।
শিশুটির ভিতরে এক ধরনের নিঃসঙ্গতা রয়েছে, স্কুলে বন্ধুবান্ধব খুব বেশি নেই। ফ্রেডি খুব মনোযোগ দিয়ে এই শিশুটিকে লক্ষ করে যাচ্ছে, খুব সাধারণ একটা শিশু হিসেবে বড় হবে সে, বয়ঃসন্ধির সময় হঠাৎ করে মানসিক বড় বড় কিছু পরিবর্তন ঘটবে। ফ্রেডি খুব ধৈর্য ধরে সেই সময়টির জন্যে অপেক্ষা করে আছেন। তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ এটি– প্রয়োজনে তার জন্যে সারা জীবন অপেক্ষা করবেন।
***
তরুণ এলবার্ট গ্র্যান্ড পিয়ানোর কাছে দাঁড়িয়ে আছে, ফ্রেডি কাছাকাছি একটা নরম চেয়ারে বসে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকে লক্ষ্য করছেন। এন্টোনিয়া ভেলেন্টাইনের বইয়ে তরুণ আইনস্টাইনের যে ছবিটি রয়েছে তার সাথে এই তরুণটির একচুল পার্থক্য নেই। সেই অবিন্যস্ত ব্যাকব্রাশ করা চুল, উঁচু কপাল, সূক্ষ্ম গোঁফের রেখা–ঠোঁটের কোনায় এক ধরনের হাসি যেটা প্রায় বিদ্রুপের কাছাকাছি। ছবিটিতে আইনস্টাইন থ্রিপিস স্যুট পরে ছিলেন–সেই যুগে যেরকম চল ছিল, এলবার্ট একটা জিন্সের প্যান্ট এবং গাঢ় নীল রঙের টি–শার্ট পরে আছে–এইটুকুই পার্থক্য।
ফ্রেডি একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে বললেন, এলবার্ট আমি আজকে তোমার সাথে একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা বলব। খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমি এই কথাটি বলার জন্যে এক যুগ থেকেও বেশি সময় ধরে অপেক্ষা করে আছি।
এলবার্ট উৎসুক দৃষ্টিতে ফ্রেডির দিকে তাকিয়ে রইল। ফ্রেডি বললেন, তুমি আমার কাছে বস।
এলবার্ট এগিয়ে এসে কাছাকাছি একটা চেয়ারে বসল, তার চোখেমুখে হঠাৎ এক ধরনের সূক্ষ্ম অসহিষ্ণুতার ছাপ পড়ে। ফ্রেডি ভুরু কুঁচকে বললেন, কোনো সমস্যা?
না, ঠিক সমস্যা নয়। তবে
তবে?
আজ বিকেলে আমার জুডিকে নিয়ে একটা কনসার্টে যাবার কথা।
কনসার্ট? কিসের কনসার্ট?
ট্রায়ো ইন দ্য ওয়াগন।
ফ্রেডি চোখ কপালে তুলে বললেন, মাই গড! তুমি ঐসব কনসার্টে যাও? আমি ভেবেছিলাম–
এলবার্ট সাথে সাথে কেমন যেন আত্মরক্ষামূলক ভঙ্গি করে বলল, কী ভেবেছিলে?
না, কিছু না।
ফ্রেডি বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকেন। খানিকক্ষণ খুব যত্ন করে নিজের নখগুলি পরীক্ষা করেন, তারপর এলবার্টের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি কি জান তুমি কে?
এলবার্ট অবাক হয়ে বলল, আমি?
হ্যাঁ।
আমি–আমি এলবার্ট।
তুমি অবশ্যি এলবার্ট। কিন্তু তুমি কি জান তুমি কোন এলবার্ট?
এলবার্ট অনিশ্চিতের মতো মাথা নাড়ল, দেখে মনে হল সে প্রশ্নটা বুঝতে পারে নি।
ফ্রেডি একটা বড় নিশ্বাস নিয়ে বললেন, তুমি এলবার্ট আইনস্টাইন।
এলবার্ট কথাটিকে একটা রসিকতা হিসেবে নিয়ে হেসে উঠতে গিয়ে ফ্রেডির দিকে তাকিয়ে থেমে গেল। বিভ্রান্তের মতো কিছুক্ষণ ফ্রেডির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি কী বলছ বুঝতে পারছি না।
তুমি বুঝতে পেরেছ, বিশ্বাস করতে পারছ তাই না?
না, মানে।
হ্যাঁ। তুমি ভুল শোন নি, আমিও ভুল বলি নি। তুমি সত্যি সত্যি এলবার্ট আইনস্টাইন। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী এলবার্ট আইনস্টাইন।
এলবার্ট অসহিষ্ণুভাবে মাথা নেড়ে বলল, আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
ফ্রেডি একটু সামনে ঝুঁকে পড়ে বলল, বুঝতে পারবে। বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বুঝতে পারে না এরকম বিষয় খুব বেশি নেই। তুমি নিশ্চয়ই ক্লোন কথাটির অর্থ জান?
এলবার্টের মুখমণ্ডল হঠাৎ রক্তশূন্য হয়ে যায়, ক্লোন?
হ্যাঁ, ক্লোন। যেখানে মানুষের একটিমাত্র কোষ থেকে ছেচল্লিশটি ক্রমোজম নিয়ে পুরো মানুষটিকে হবহু জন্ম দেয়া যায়।
জানি। এলবার্ট মাথা নাড়ল, আমি ক্লোন সম্পর্কে জানি। আমাদের পড়ানো হয়।
তুমি সেরকম একটি ক্লোন। জেনেভার এক ল্যাবরেটরি থেকে আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের টিস্যু চুরি করে নিয়ে তোমাকে তৈরি করা হয়েছিল। তুমি এবং মহাবিজ্ঞানী এলবার্ট আইনস্টাইন একই ব্যক্তি।
মিথ্যা কথা। এলবার্ট মাথা নেড়ে বলল, বিশ্বাস করি না আমি। বিশ্বাস করি না।
ফ্রেডি শীতল গলায় বললেন, তুমি বিশ্বাস না করলেও কিছু আসে যায় না এলবার্ট। ব্যাপারটি সত্যি। আমার কাছে সব প্রমাণ আছে তোমার জন্যে নিয়ে এসেছি। এই দেখ–
ফ্রেডি তার পকেট থেকে কিছু কাগজপত্র বের করে এলবার্টের হাতে দিলেন, বললেন, জিনেটিক ব্যাপারগুলি বোঝা খুব সহজ নয় কিন্তু তুমি আইনস্টাইন, পৃথিবীতে তোমার মতো মস্তিষ্ক একটিও নেই। তুমি নিশ্চয়ই বুঝবে। দেখ।