ছোটখাটো মানুষটি ছবি দুটি নেয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে বলল, আপনাকে নিশ্চয়ই এর গুরুত্ব বুঝিয়ে বলতে হবে না।
ফ্রেডি কোনো কথা না বলে স্থির দৃষ্টিতে মানুষটির দিকে তাকিয়ে রইলেন, খানিকক্ষণ পর চেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন, আটানব্বই সালে আইন করে সারা পৃথিবীতে মানুষের ক্লোন করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
মানুষটি মুখ নিচু করে খিকখিক করে হেসে বলল, অবশ্যই কাজটা বেআইনি। নিউক্লিয়ার পাওয়ার স্টেশনে অন্তর্ঘাত চালিয়ে ব্যবসা থেকে উঠিয়ে দেয়াও বেআইনি ছিল। আভ্যন্তরীণ খবর কিনে স্যাটেলাইট সিস্টেম পুরোটা দখল করে নেয়াও বেআইনি ছিল, কিন্তু আপনি সেজন্যে নিরুৎসাহিত হন নি। জেনেভার জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিঙের ফার্ম আপনি যেভাবে কিনতে যাচ্ছেন সেটাও পুরোপুরি বেআইনি। আপনি পৃথিবীর সবচেয়ে ঐশ্বর্যশালী মানুষদের এক জন, আপনার তো আইনকে ভয় পাওয়ার কথা নয়–আপনার আইনকে নিয়ন্ত্রণ করার কথা।
আমি আইনকে ভয় করি না, কারণ পৃথিবীর কোথাও কেউ প্রমাণ করতে পারবে না আমি আইন ভঙ্গ করেছি।
ছোটখাটো মানুষটি মুখের হাসি বিস্তৃত করে বলল, আপনাকে আমি একবারও আইন ভঙ্গ করতে বলি নি। ল্যাবরেটরি থেকে টিস্যু সরিয়ে যে আইনস্টাইনকে ক্লোন করেছে সে আইন ভেঙেছে। একবার ক্লোনের জন্ম হওয়ার পর সে পৃথিবীর মানবশিশু–কারো সাধ্যি নেই তাকে স্পর্শ করে। আপনি শুধুমাত্র তার অভিভাবকত্ব গ্রহণ করবেন–সেটি হবে পুরোপুরি আইনের ভিতরে। তারপর তাকে আপনি কীভাবে বাজারজাত করবেন সেটি পুরোপুরি আপনার ব্যাপার! মানুষটি এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, আমার ধারণা। একবিংশ শতাব্দীতে কীভাবে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ একজন বিজ্ঞানীকে ব্যবহার করা যাবে সেটি আপনার চাইতে ভালো করে আর কেউ জানে না।
ফ্রেডি চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করলেন। ভবিষ্যৎ–মুখী বিনিয়োগে, সারা পৃথিবীতে তার কোনো জুড়ি নেই, সত্যি সত্যি এ ব্যাপারে তার প্রায় এক ধরনের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় রয়েছে। যদিও মানুষকে ক্লোন করার ব্যাপারটি বেআইনি, কিন্তু এটি যে অসংখ্যবার ঘটেছে। সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। সাধারণ মানুষকে ক্লোন করে তার দ্বিতীয় তৃতীয় কিংবা অসংখ্য কপি তৈরি করে সত্যিকার অর্থে পৃথিবীর কোনো লাভ–ক্ষতি হয় নি। তবে আইনস্টাইনের মতো একজন মানুষের বেলায় সেটি অন্য কথা, এটি পৃথিবীর সমস্ত ভারসাম্যের ওলটপালট করে দিতে পারে। জেনারেল রিলেটিভিটির যে সমস্ত সমস্যার এখনো সমাধান হয় নি তার বড় একটা যদি সমাধান করিয়ে নেয়া যায় তাহলে কী সাংঘাতিক একটা ব্যাপার হবে! মানুষ আইনস্টাইনকে দেখেছে পরিণত বয়সে, কৈশোরের আইনস্টাইন, যৌবনের আইস্টাইন নিয়ে সাধারণ মানুষের নিশ্চয়ই কী সাংঘাতিক কৌতূহল। ঠিকভাবে বাজারজাত করা হলে এখান থেকে কী হতে পারে তার কোনো সীমা নেই। যদি এই ক্লোন থেকে আরো ক্লোন করা যায় দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে এক জন করে আইনস্টাইন দেয়া যায়–ফ্রেডি আর চিন্তা করতে পারেন না, তার ব্যবসায়ী মস্তিষ্ক হঠাৎ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। চোখ খুলে তিনি ছোটখাটো মানুষটির দিকে তাকালেন, কত?
মানুষটির মুখে আবার তৈলাক্ত হাসিটি বিস্তৃত হল, বলল, অর্থের পরিমাণটি তো। গুরুত্বপূর্ণ নয়–আপনি রাজি আছেন কি না সেটি গুরুত্বপূর্ণ।
তবু আমি শুনতে চাই। কত?
মানুষের বিনিয়োগের ব্যাপারটি কিন্তু আপনাকে দিয়েই শুরু হবে। আমি যতদূর জানি এলভিস প্রিসলি, মেরিলিন মনরো এবং উইনস্টন চার্চিলের ক্লোন করার চেষ্টা করা হচ্ছে। সেগুলি কীভাবে নিয়ন্ত্রণ হবে, হঠাৎ করে মারা গেলে কীভাবে ইস্যুরেন্স করা হবে তার সবকিছু কিন্তু এইটি দিয়ে ঠিক করা হবে।
ফ্রেডি মাথাটা একটু এগিয়ে এনে বললেন, আপনি এখনো আমার প্রশ্নের উত্তর দেন নি। কত?
মানুষটি তার জিব বের করে ঠোঁট দুটি ভিজিয়ে বলল, আমরা খোঁজ নিয়েছি, সাদা এবং কালো মিলিয়ে আপনার সেই পরিমাণ লিকুইড ক্যাশ রয়েছে।
ফ্রেডি একটা নিশ্বাস ফেলে সোজা হয়ে বসলেন, তারপর থমথমে গলায় বললেন, ঠিক আছে, আমার এটর্নি চুক্তিপত্র স্বাক্ষর করার জন্যে আপনার এটর্নির সাথে যোগাযোগ করবে। তবে
তবে?
এটি যে সত্যিই আইনস্টাইনের ক্লোন এবং আন্তর্জাতিক কোনো জোচ্চুরির অংশ নয় সেটি আমি নিজেই নিশ্চিত হয়ে নেব। মাউন্ট সাইনাই হাসপাতাল থেকে আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের টিস্যু সংগ্রহ করে আমি নিজে আমার নিজের জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়ে নেব।
অবশ্যি। আপনি যে পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করবেন তার জন্যে এটি তো করতেই হবে। ছোটখাটো মানুষটি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমাকে খানিকক্ষণ সময় দেয়ার জন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ। আমি নিশ্চিত আজকে এখান থেকে পৃথিবীর ইতিহাসে একটা নূতন দিগন্ত উন্মোচিত হতে যাচ্ছে।
ফ্রেডি কোনো কথা না বলে শীতল চোখে মানুষটির দিকে তাকিয়ে রইলেন।
***
সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী এলবার্ট আইনস্টাইনের ক্লোনশিশুটি চুপচাপ ধরনের–ঠিক যেরকম হওয়ার কথা। শিশুটি কথা বলে মৃদু স্বরে–তার সাথে যে সারোগেট মা রয়েছেন তার কাছে জানা গেল, শিশুটি কথা বলতে শুরু করেছে অনেক দেরি করে, ঠিক সত্যিকার আইনস্টাইনের মতো।
শিশুটির নাম দেয়া হয়েছে এলবার্ট খুব সঙ্গত কারণেই। ফ্রেডি অভিভাবকত্ব গ্রহণ করার পর একদিন শিশুটিকে দেখতে গিয়েছিলেন, বাচ্চাটি তার কাছেই এল না, দূরে দাঁড়িয়ে থেকে তার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। ফ্রেডি ভাব করার খুব বেশি চেষ্টা করলেন না, তার জন্যে প্রায় পুরো জীবনটাই পড়ে রয়েছে। শিশুটির দিকে তাকিয়ে তার ভিতরে বিচিত্র এক ধরনের ভাব খেলা করতে থাকে, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী এলবার্ট আইনস্টাইনকে তিনি সংগ্রহ করেছেন। তার ছবি নয়, তার হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি নয়, তার ব্যবহার্য পোশাক নয়–স্বয়ং মানুষটিকে। পৃথিবীর ইতিহাসে কি এর আগে কখনো এরকম কিছু ঘটেছে? মনে হয় না। এই আইনস্টাইনকে তিনি গড়ে তুলবেন। প্রকৃত আইনস্টাইন তাঁর জীবনের অসংখ্য ঘাত–প্রতিঘাতে যে কাজ করতে পারেন নি তিনি এই শিশুকে দিয়ে সেইসব করিয়ে নেবেন। শুধু অর্থ নয়, খ্যাতি এবং ইতিহাস সৃষ্টি করবেন এই শিশুটিকে দিয়ে।