ফ্রেডি গ্রানাইটের কালো টেবিলে আঙুল দিয়ে শব্দ করছিল, হঠাৎ করে সেটা বন্ধ করে মানুষটিকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলল, কাজের কথায় আসা যাক।
মানুষটি এতটুকু বিচলিত না হয়ে মাথা নেড়ে বলল, আসা যাক।
আপনি দাবি করছেন আমার টাকা বিনিয়োগের এর থেকে বড় সুযোগ আর কোথাও নেই?
না, নেই। ছোটখাটো মানুষটির গলার স্বর যে আনুনাসিক হঠাৎ করে সেটা কেমন যেন স্পষ্ট হয়ে উঠল।
আপনি কেমন করে এত নিশ্চিত হলেন? আমি কোথায় কোথায় টাকা বিনিয়োগ করেছি আপনি জানেন?
মোটামুটিভাবে জানি। সেজন্যেই অন্য কারো কাছে যাবার আগে আপনার কাছে এসেছি।
ফ্রেডি ভুরু কুঁচকালেন, মানে?
পৃথিবীর সাধারণ মানুষ যখন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স–এর নাম শোনে নি তখন আপনি সান হোসের সবচেয়ে বড় এ. আই. ফার্মটি কিনেছেন। নিউক্লিয়ার পাওয়ার যে পৃথিবী থেকে উঠে যাবে সেটি অন্যেরা বোঝার অন্তত দশ বছর আগে আপনি বুঝেছিলেন। প্রচুর অর্থ নষ্ট করে আপনি সেখান থেকে সরে এসে কয়েক বছরের মাঝে আপনার বিশাল সম্পদকে রক্ষা করেছেন। স্পেস সায়েন্সে মোটা টাকা লোকসান দিয়ে আপনি সেটাকে দশ বছর ধরে রাখলেন–এখন সারা পৃথিবীতে আপনার একচ্ছত্র মনোপলি। জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিঙে আপনি পৃথিবীর সবচয়ে বড় বিনিয়োগটি করতে যাচ্ছেন। জেনেভার সবচেয়ে বড় জিনেটিক ল্যাবটিতে আপনি বিড করেছেন–
ফ্রেডি সোজা হয়ে বসলেন, আপনি কেমন করে জানেন?
আমি জানি সেটাই হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ। মানুষটি মাথা নেড়ে বলল, কেমন করে জানি সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়।
ব্যাপারটা গোপন থাকার কথা।
ব্যাপারটা এখনো গোপনই আছে। আমি জানলেও তথ্য গোপন থাকে বলে আমি অনেক তথ্য জানতে পারি।
ফ্রেডি আবার তার আঙুল দিয়ে অন্যমনস্কভাবে টেবিলে টোকা দিতে শুরু করলেন, বললেন, ঠিক আছে, এখন তুমি বল আমি কিসে বিনিয়োগ করব?
মানুষে।
মানুষে!
হ্যা মানুষে। আপনি নিশ্চয়ই জানেন ভবিষ্যতের বিনিয়োগ হবে মানুষে। সত্যিকার মানুষে। রক্তমাংসের মানুষে।
ফ্রেডি কোনো কথা না বলে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন। মানুষটি মাথা এগিয়ে এনে ষড়যন্ত্রীদের মতো বলল, হেঁজিপেজি মানুষে নয়–পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষে। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষে।
ফ্রেডি মাথা নাড়লেন, আপনি কী বলছেন আমি বুঝতে পারছি না।
ছোটখাটো তৈলাক্ত চেহারার মানুষটি একটি ম্যাগাজিন ফ্রেডির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, এটা দেখেন, তাহলেই বুঝতে পারবেন।
ফ্রেডি ম্যাগাজিনটি হাতে নিলেন, পুরোনো একটি নিউজউইক। যে লেখাটি দেখতে দিয়েছে সেটা লাল কালি দিয়ে বর্ডার করে রাখা। ফ্রেডি চোখে চশমা লাগিয়ে লেখাটি পড়লেন, জেনেভার একটি ল্যাবরেটরিতে আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের খানিকটা টিস্যু সংরক্ষিত ছিল, সেটি খোয়া গেছে। জোর পুলিশি তদন্ত চলছে।
ফ্রেডি কিছুক্ষণ নিশ্বাস বন্ধ করে লেখাটির দিকে তাকিয়ে রইলেন, তিনি বেশ কয়েক বছর আগে এই সংবাদটি পড়েছিলেন, কেন এই টিস্যু খোয়া গেছে তিনি সাথে সাথে বুঝতে পেরেছিলেন। এখন এই তৈলাক্ত পিচ্ছিল চেহারার মানুষটির দিকে তাকিয়ে হঠাৎ পুরো ব্যাপারটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তার হৃৎস্পন্দন হঠাৎ দ্রুততর হয়ে যায়। তিনি খুব সতর্কভাবে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে ধীরে ধীরে বললেন, আপনি ঠিক কী বলতে চাইছেন?
আপনি যদি বুঝতে না পারেন আমার কিছু বলার কোনো অর্থ নেই। আর আপনি যদি বুঝতে পেরে থাকেন তাহলে আমার কিছু বলার কোনো প্রয়োজন নেই।
ফ্রেডি তীক্ষ্ণ চোখে মানুষটার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললেন, আপনি–আপনি বলতে চাইছেন আইনস্টাইনকে ক্লোন করা হয়েছে?
ছোটখাটো মানুষটির মুখে একটি তৈলাক্ত হাসি বিস্তৃত হল। মাথা নেড়ে বলল, আপনি যথার্থ অনুমান করেছেন। আইনস্টাইনকে ক্লোন করা হয়েছে।
সত্যি?
সত্যি।
তাকে মাতৃগর্ভে ঠিকভাবে বর্সানো হয়েছে?
মানুষটির মুখের হাসি আরো বিস্তৃত হল, বলল, সে অনেকদিন আগের কথা।
তার মানে আপনি বলতে চাইছেন আইনস্টাইনের ক্লোনের জন্ম হয়ে গেছে?
অবশ্যি। যদি সুস্থভাবে জন্ম না হত আমি কি আপনার কাছে আসতাম?
কোথায় জন্ম হয়েছে? কবে জন্ম হয়েছে?
এই দেশেই জন্ম হয়েছে। প্রায় বছর চারেক হল।
কোথায় আছে সেই ক্লোন?
ছোটখাটো মানুষটি খুব ধীরে ধীরে মুখের হাসি মুছে সেখানে একটি গাম্ভীর্য ফুটিয়ে তুলে বলল, সেই শিশুটি কোথায় আছে আমি বলতে পারব না। বুঝতেই পারছেন নিরাপত্তার ব্যাপার রয়েছে। যেটুকু বলতে পারি সেটা হচ্ছে সে তার সারোগেট মায়ের সাথে আছে। অনেক খুঁজে পেতে এই মা’কে বেছে নেয়া হয়েছে, অর্ধেক জার্মান এবং অর্ধেক সুইস। অত্যন্ত মায়াবতী মহিলা।
ফ্রেডি তখনো ঠিক ব্যাপারটি বিশ্বাস করতে পারছিলেন না, খানিকটা হতচকিতের মতো ছোটখাটো মানুষটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। মানুষটি তার বুকপকেট থেকে দুটি ছবি বের করে ফ্রেডির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, এই যে আইনস্টাইনের শৈশবের ছবি। একটি নিয়েছি এন্টনিয়া ভেলেন্টিনের লেখা বই থেকে। অন্যটি সপ্তাহখানেক আগে তোলা।
ফ্রেডি হতবাক হয়ে ছবি দুটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। আইনস্টাইনের শৈশবের ছবির সাথে কোনো পার্থক্য নেই, সেই ভরাট গাল, কোঁকড়া চুল, গভীর মায়াবী চোখ! পার্থক্য কেমন করে থাকবে? আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের টিস্যু থেকে একটা কোষ আলাদা করে তার ছেচল্লিশটি ক্রমোজম একটি মায়ের ডিম্বাণুতে ঢুকিয়ে সেটি মাতৃগর্ভে বসানো হয়েছে। যে ক্রমোজমগুলি একটি ডিম্বাণু থেকে আইনস্টাইনের জন্ম দিয়েছে সেই একই ক্রমোজম এই আইনস্টাইনের জন্ম দিয়েছে। যে শিশুটির জন্ম হয়েছে সে তো আইনস্টাইনের মতো একজন নয়, সে সত্যি সত্যি আইনস্টাইন।