সাংবাদিক সম্মেলনের আগের রাতে প্রফেসর জোয়ারদার আবার ল্যাবরেটরিতে এসে শেষবারের মতো সবকিছু দেখে নিচ্ছেন। সুইচ টিপে ভবিষ্যৎ থেকে কোনো কিছুকে অতীতে টেনে আনার জটিল যন্ত্রটি চালু করার সময় হঠাৎ তার মাথায় একটা বিচিত্র সম্ভাবনার কথা মনে হল, তিনি কি কোনোভাবে তারেককে খুন করে ফেলতে পারেন না? এই যে বিশাল কাজটি, একটা আবিষ্কার তার সম্মানটুকু পুরোপুরিই তার কাছে আসছে, কিন্তু যতদিন তারেক বেঁচে থাকবে এর ভিতটি হবে খুব নড়বড়ে যদি তাকে কোনোভাবে শেষ করে দেয়া যায় পৃথিবীতে আর কেউ তাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারবে না।
প্রফেসর জোয়ারদার জোর করে চিন্তাটা মাথা থেকে সরিয়ে দিলেন। তিনি লোভী এবং দুর্বল চরিত্রের মানুষ, মানুষ খুন করার মতো শক্তি বা সাহস তার নেই। বিশ্বজোড়া আবিষ্কারের এই সম্মানটুকু সারাক্ষণ তাকে ভয়ে ভয়েই উপভোগ করতে হবে।
প্রফেসর জোয়ারদার সুইচটা অন করতেই ঘরঘর শব্দ করে বহুষ্কোণ একটা অংশে ভ্যাকুয়াম পাম্প চালু হয়ে যায়। উচ্চচাপের বিদ্যুতে বিশাল একটা অংশ আয়োনিত করে সেখানে অনেকগুলি লেজার রশ্মি খেলা করতে থাকে। রেডিয়েশান মনিটরে অল্পশক্তির এক্স রে ধরা পড়ে এক ধরনের ভোঁতা ধাতব শব্দ করতে থাকে। প্রফেসর জোয়ারদার একটু এগিয়ে যেতেই হঠাৎ একটা বিস্ফোরণের শব্দ হল, তিনি চমকে তাল হারিয়ে পড়ে যাচ্ছিলেন, কোনোমতে নিজেকে সামলে নিলেন। হঠাৎ করে চারদিক অন্ধকার হয়ে গেল এবং প্রফেসর জোয়ারদারের মনে হল তিনি শূন্যে ছিটকে পড়ে গেছেন। হাত দিয়ে তিনি ধরার চেষ্টা করলেন, কিন্তু ধরার কিছু নেই–অতল শূন্যে পড়ে যাচ্ছেন। বিকট গলায় তিনি চিৎকার করতে থাকেন, মনে হল তার গলার আওয়াজ অদৃশ্য কোনো এক জগতে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এল।
.
প্রফেসর কাসেম জোয়ারদার চোখ খুলে দেখলেন তার উপর ঝুঁকে উবু হয়ে একজন মানুষ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকে দেখছে। মানুষটির চেহারা দেখে তিনি ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন, মানুষটি তিনি নিজে।
তু–তু–তুমি কে?
আমি হচ্ছি তুমি। অন্য জগৎ থেকে তুমি এখানে আমার কাছে চলে এসেছ। আমি ছোটখাটো জিনিস টেনে আনতে চাচ্ছিলাম কিন্তু মনে হচ্ছে বড় জিনিস পেয়ে গেছি। আস্ত একজন মানুষ, আর যে–সে মানুষ নয়–একেবারে নিজেকে।
প্রফেসর কাসেম জোয়ারদার নিজের ভিতরে এক ধরনের অসহনীয় আতংক অনুভব করতে থাকেন। শুকনো গলায় বললেন, আমি বুঝতে পারছি না, কিছু বুঝতে পারছি না।
মানুষটি হা হা করে হেসে বলল, না বোঝার কিছু নেই এখানে, তুমি তো আমি। আমি যদি বুঝি, তুমি বুঝবে না কেন?
তারেক–তারেক কোথায়?
ঐ যে। মেঝেতে পড়ে আছে। হাই টেনশান তার এসে লেগেছে হঠাৎ– হার্টবিট বন্ধ হয়ে মরে গেছে।
প্রফেসর কাসেম জোয়ারদার তীক্ষ্ণ চোখে তার নিজের মতো মানুষটির দিকে তাকালেন, হঠাৎ করে তিনি বুঝতে পারলেন এই জগতের প্রফেসর কাসেম জোয়ারদার তার মতো ভীরু কাপুরুষ নয়, সে ঠাণ্ডা মাথায় তারেককে খুন করে ফেলেছে। তিনি শুকনো ঠোঁট জিব দিয়ে ভিজিয়ে বললেন, তুমি তারেককে খুন করেছ?
মানুষটি হা হা করে হেসে বলল, কী বলছ তুমি পাগলের মতো? প্রমাণ আছে কোথাও?
প্রফেসর জোয়ারদার মাথা নাড়লেন, বললেন, না প্রমাণ নেই।
মানুষটি উঠে দুই পা পিছিয়ে গিয়ে বলল, তুমি অন্য জগৎ থেকে এসেছ–মানুষটা আমি হলেও তুমি পুরোপুরি আমি নও। আমার কী মনে হয় জান?
কী?
তুমি উল্টোপাল্টা কথা বলে ঝামেলা করতে পার।
কী ঝামেলা?
প্রফেসর কাসেম জোয়ারদার দেখলে মানুষটি হাতে একটা লোহার রড তুলে নিয়ে বলল, অন্য কোনো জগৎ থেকে যদি আমি নিজেকে টেনে আনতে পারি এক–দুইটা নোবেল প্রাইজের জন্য সেটাই যথেষ্ট। তাকে জীবন্ত টেনে আনতে হবে কে বলেছে! কী বল তুমি?
প্রফেসর জোয়ারদার নিজের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলেন না। ফ্যালফ্যাল করে তার নিজের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
আইনস্টাইন
ফ্রেডি তার সামনে বসে থাকা মানুষটিকে খুব ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলেন। মানুষটি আকারে ছোট, মাথার চুল হালকা হয়ে এসেছে, গোসল সেরে খুব সতর্কভাবে চুল আঁচড়ালে যে কয়টি চুল আছে সেগুলি দিয়ে মোটামুটিভাবে মাথাটা ঢাকা যায়। মানুষটির চেহারায় একটি তৈলাক্ত পিচ্ছিল ভাব রয়েছে, মুখের চামড়া এখনো কুঁচকে যায় নি বলে প্রকৃত বয়স ধরা যায় না, চোখ দুটি ধূসর এবং সেখানে কেমন জানি এক ধরনের মৃত–মানুষ মৃত–মানুষ ভাব রয়েছে। মানুষটির স্যুটটি দামি, টাইটি রুচিসম্মত, কাপড় নিউজ। চেহারা দেখে কখনো কোনো মানুষকে বিচার করা ঠিক নয়, কিন্তু তবুও ফ্রেডি মানুষটিকে অপছন্দ করে ফেললেন। তিনি অন্যমনস্কভাবে মানুষটির দিকে তাকিয়ে থেকে তার কথা শোনার ভান করতে থাকেন যদিও, তার মনোযোগ কেন্দ্রীভূত হয়ে থাকে মানুষটির কথা বলার ভঙ্গিতে, ঠোঁট কুঁচকে ওঠায়, দাঁত বের হওয়ার মাঝে।
আপনি পৃথিবীর প্রথম দশ জন ঐশ্বর্যশালী মানুষের এক জন। মানুষটি মুখে এক ধরনের হাসি ফুটিয়ে বলল, আমি জানি আপনার সাথে দেখা করার থেকে একজন মন্ত্রীর স্ত্রীর সাথে ফষ্টিনষ্টি করা সহজ–তবুও আমাকে খানিকটা সময় দিয়েছেন বলে অনেক ধন্যবাদ। তবে আমি নিশ্চিত আপনি শুধু শুধু আমার সাথে খানিকটা সময় ব্যয় করতে রাজি হন নি। আমার প্রস্তাবটা ভেবে দেখেছেন, আমার সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছেন।