***
সাত নম্বর সেল নামক যে ঘরটিতে আমাকে আটকে রাখা হল সেটি আগের ঘরটির মতোই আসবাবপত্রহীন এবং নিরানন্দ একটি কুঠুরি। ঘরটির দরজা বন্ধ হবার সাথে সাথে দরজা জানালাহীন নিচ্ছিদ্র এই ঘরটিকে একটি বদ্ধ খাঁচার মতো এবং নিজেকে আক্ষরিক অর্থে খাঁচায় আটকেপড়া একটি ইঁদুরের মতো মনে হতে থাকে। আমি ঘরের ভিতরে কয়েকবার পায়চারি করে কষ্ট করে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত এক কোনায় বসে নিজের হাঁটুর উপর মুখ রেখে সিস্টেম এডিফাসের জন্যে অপেক্ষা করতে থাকি। আমার মনে হতে থাকে আমাকে কেউ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ্য করছে। অপেক্ষা করে করে আমি যখন অধৈর্য হয়ে উঠলাম ঠিক তখন শুনতে পেলাম ভারি গলায় কেউ একজন আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, সিস্টেম এডিফাস তোমাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে।
যে কারণেই হোক, আমার নিজেকে খুব আমন্ত্রিত মনে হল না বলে আমি চুপ করে রইলাম। সিস্টেম এডিফাস আবার বলল, তুমি নিশ্চয়ই জান যে তোমাকে একটা খুনের মামলার সন্দেহভাজন ব্যক্তি হিসেবে আনা হয়েছে।
আমার কথা বলার ইচ্ছে করছিল না, কিন্তু চুপ করে থাকলে যদি পরোক্ষভাবে ঘটনাটির সত্যতা স্বীকার করা হয়ে যায় সেই ভয়ে আমি বললাম, আমি কিছুই করি নি, এ ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না।
তুমি সত্যিই কিছু কর নি কি না সেটা কিছুক্ষণের মাঝেই আমি বের করব।
কীভাবে বের করবে?
তুমি একটি ফ্যারাডে কেজে রয়েছ। অসংখ্য মনিটর তোমার নিশ্বাস, প্রশ্বাস, হৃৎস্পন্দন, রক্তচাপ, মস্তিষ্কের সবগুলি দীর্ঘ লয় এবং স্বল্প লয়, তরঙ্গ, তাপমাত্রা, ত্বকের জলীয় বাষ্প ইত্যাদি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নজর রাখছে। তোমার মুখের প্রতিটি শব্দকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করে দেখা হবে তুমি সত্যি কথা না মিথ্যা কথা বলছ।
আমি আশান্বিত হয়ে বললাম, আমি সত্যি কথা বললে তুমি বুঝতে পারবে?
অবশ্যি।
তাহলে শোন, আমি পুরোপুরি নির্দোষ।
আমার সাথে যে কণ্ঠস্বরটি কথোপকথন করছিল সেটি হঠাৎ করে পুরোপুরি নীরব হয়ে গেল। আমি ভয় পাওয়া গলায় বললাম, কী হল? তোমার যন্ত্রপাতি কী বলছে? আমি কি সত্যি কথা বলছি?
হ্যাঁ। আমার যন্ত্রপাতি বলছে তুমি সত্যি কথা বলছ। তবে—
তবে কী?
তুমি ঠিক কোন ব্যাপারে নির্দোষ সেটি পরিষ্কার হল না।
এই ব্যাপারে, যে ব্যাপারে আমাকে ধরে এনেছ।
সেটি কোন ব্যাপার?
আমি তো ভালো করে জানিও না। আমি বেঞ্চে বসে খাচ্ছিলাম
আমাকে বাধা দিয়ে সিস্টেম এডিফাস বলল, তুমি কি বলতে চাইছ ঘটনাটি তুমি ভালো করে জানই না?
না।
যে ঘটনাটি তুমি জানই না সেখানে তুমি দোষী নির্দোষ সেটি কেমন করে বলবে?
আমি সিস্টেম এডিফাসের কথায় হঠাৎ এক ধরনের আতংক অনুভব করলাম। একজন মানুষের সাথে আরেকজন মানুষ পুরোপুরি অর্থহীন একটা ব্যাপারে দীর্ঘ সময় কথা বলতে পারে, কিন্তু একটি যন্ত্রের সাথে সেটি কি করা সম্ভব? যন্ত্র কি কোনো নিরীহ কথাকে ভুল বুঝতে পারে না? আমি কী বলব ঠিক করার চেষ্টা করছিলাম ঠিক তখন সিস্টেম এডিফাস ভারি গলায় বলল, আমাদের তথ্য অনুযায়ী তুমি এখন বিভ্রান্ত এবং কিছু একটা কৃত্রিম উত্তর তৈরি করার চেষ্টা করছ।
না, আমি কোনো কৃত্রিম উত্তর তৈরি করছি না। একটা যন্ত্রের সাথে কীভাবে অর্থপূর্ণ কথা বলা যায় সেটি ভেবে বের করার চেষ্টা করছি।
বেশ। আমরা তাহলে ঘটনাটি একটু বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করি। দেশের একজন অত্যন্ত কুখ্যাত মানবদেহের অঙ্গ–প্রত্যঙ্গ ব্যবসায়ী তোমার কোলে মৃত্যুবরণ করেছে। তার দেহে সাতটি রনোগানের ক্ষতচিহ্ন ছিল, তোমাকে যখন গ্রেপ্তার করা হয় তখন তোমার। হাতেও ছিল একটা রনোগান। তোমার সাথে এই দুর্ধর্ষ খুনি মানুষের কত দিনের পরিচয়?
তার সাথে আমার কোনো পরিচয় নেই।
তাহলে এত মানুষ থাকতে সে কেন তোমার দিকে ছুটে এল?
এটি–এটি একটি কাকতালীয় ঘটনা! সে যে কোনো মানুষের দিকে ছুটে যেতে পারত।
সিস্টেম এডিফাস এক মুহূর্ত নীরব থেকে বলল, আমি যখন তোমাকে এই দুর্ধর্ষ খুনিটি নিয়ে প্রশ্ন করেছি তখন তোমার রক্তচাপ বৃদ্ধি পেয়েছে, তোমার মস্তিষ্কে একটা মধ্যম লয়ের নিচু তরঙ্গের সৃষ্টি হয়েছে তার কারণ কী? তুমি কি সত্য গোপন করেছ?
আমি চমকে উঠে বললাম, না, আমি কোনো সত্য গোপন করি নি।
এই ভয়ংকর অপরাধী সম্পর্কে তোমার কী ধারণা?
আমার কোনো ধারণাই নেই। সত্যি কথা বলতে কী, আমি যখন প্রথম তাকে দেখেছি। আমার মনে হয়েছে মানুষটির মাঝে একটি শান্ত সমাহিত ভাব আছে। আমি বুঝতেই পারি নি সে এত বড় অপরাধী।
বুঝতেই পার নি?
না।
তার সম্পর্কে তোমার একটা শ্রদ্ধার ভাব ছিল?
শ্রদ্ধা কি না জানি না, মানুষটাকে দেখে তার ভিতরে একটা পবিত্রতা ছিল বলে মনে হয়েছিল।
এতবড় একজন দুর্ধর্ষ খুনি কিন্তু তাকে দেখে তোমার মনে হল পবিত্র?
আমি একটু অধৈর্য হয়ে বললাম, মানুষের চেহারা সব সময় সত্যি কথা বলে না; এটি নূতন কিছু নয়। পৃথিবীতে অনেক সুদর্শন দুশ্চরিত্র মানুষ রয়েছে।
এতবড় একজন অপরাধী তোমার ভিতরে পবিত্র ভাব এনেছে সেজন্যে তোমার ভিতরে কি কোনো অপরাধবোধ আছে?
না, অপরাধবোধ নেই। কেন থাকবে?
আশ্চর্য!
কোন জিনিসটা আশ্চর্য?
তোমার মুখের প্রত্যেকটা উক্তির আমি সত্যতা যাচাই করে দেখেছি। তুমি মুখে যেটা বলেছ তার সাথে সত্যতার গরমিল রয়েছে। যেমন মনে কর পবিত্রতার কথা। পবিত্রতা জিনিসটি মূলত ধর্মসংক্রান্ত কাজে ব্যবহার করা হয়। আমার যে মূল তথ্যকেন্দ্র রয়েছে সেখানে পবিত্রতা কথাটির উনচল্লিশ ধরনের অর্থ রয়েছে।